জনকথা প্রতিবেদক: এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় মানসম্পন্ন শিক্ষায় অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষায় অগ্রগতি একেবারেই কম। ফলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বেকারত্ব কমছে না। এজন্য কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও দক্ষ করে তুলতে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। এই ব্যয়ের ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
অভিযোগ উঠেছে ঋণের টাকার এই প্রকল্প থেকে লুটপাটের পরিকল্পনা সাজিয়েছে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (বিটিইবি)। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, যেখানে অন্যান্য প্রকল্পে প্রতি বর্গমিটার ভবন নির্মাণে খরচ ৪০-৫০ হাজার টাকা, সেখানে এই প্রকল্পে গড় ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য খাতেও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ধরে লুটপাটের পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির পরিমার্জিত প্রস্তাব পাঠানো হয়। এর আগে গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পের নানা খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাবের আপত্তি জানিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। কিছু খাতে ব্যয় কিছুটা কমানো হলেও এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় ও অত্যধিক ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পটিতে এত ভবন নির্মাণের দরকার ছিল না। বিটিইবির আগেও এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তারপরও ১০০ কোটি টাকা পরামর্শকের ব্যয় ধরা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য খাতে অপ্রয়োজনীয় নানা ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মূলত এডিবির ঋণের ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছাড় করার জন্যই প্রকল্পটিতে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। কারণ ব্যয় কম দেখালে ঋণের পুরো অর্থ ছাড় করবে না সংস্থাটি। যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে, সেক্ষেত্রে এ প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হলেই যথেষ্ট ছিল।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) কাইয়ুম আরা বেগম বলেন, ‘আমরা প্রস্তাবটি আবারও যাচাই-বাছাই করে দেখব। প্রকল্পে অত্যধিক ব্যয় অনুমোদনের কোনো সুযোগ নেই।’
জানতে চাইলে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘ঋণ করে অর্থের অপব্যয় আমাদের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কার এবং নির্মাণের নামে এ ধরনের কম্পোনেন্ট রাখা অর্থের অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এগুলো মেনে নেওয়াও অনৈতিক।’
অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে ব্যয় বেশি
২০২২ সালে রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প নেওয়া হয়। সেখানে ১০ তলা অনাবাসিক ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গমিটারে ৩৮ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়। ২০২৩ সালে আগারগাঁওয়ে সংসদ সচিবালয়ের সরকারি কর্মকর্তাদের ১৫ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গমিটারে ৪৮ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস ফ্যাকাল্টি ভবন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে মাত্র ২৩ হাজার টাকা। অথচ প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে ১ লাখ ৩ হাজার ১০০ বর্গমিটার অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ৭১১ কোটি ২৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়। অর্থাৎ প্রতি বর্গমিটারে ব্যয় পড়ছে ৬৮ হাজার ৯৮৫ টাকা। আর ৪০ হাজার ২১ বর্গমিটার আবাসিক ভবন নির্মাণে খরচ ধরা হয় ২৭০ কোটি ৪৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। এখানে প্রতি বর্গমিটারে খরচ পড়ছে ৬৭ হাজার ৫৭৪ টাকা।
প্রকল্পটিতে ভবন নির্মাণে ব্যয় প্রাক্কলন করেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির ডেস্ট-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই এডিবির পরামর্শকরাই করেছেন। তাদের ব্যয় ধরেই আমরা এটা দিয়েছি, আমরা নিজে থেকে কোনো ব্যয় প্রাক্কলন করিনি। অনেক ভবন নির্মাণে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকাও রয়েছে। কোনো ভবন নির্মাণেই ৬৬ হাজার টাকার বেশি নেই।’
তাহলে গড়ে ভবন নির্মাণের ব্যয় ৬৭-৬৮ হাজার টাকা হলো কীভাবে? সেটা জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘সামনে রেটশিডিউল বাড়লে আবার তো ব্যয় বাড়বে, তাই ধরা হয়েছে।’
অর্থাৎ ভবিষ্যতে কাজে ঢিলেমি বা অন্যান্য কারণে যদি প্রকল্পের কাজ সঠিক সময়ে শেষ করতে না পারে, তখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে সেটা এই অতিরিক্ত ব্যয় থেকেই মেটানো হবে। আর ব্যয় কম হলে কি অন্যান্য নতুন খাত যুক্ত করে অযথা অর্থ ব্যয় করা হবে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। যদিও পরিকল্পনা কমিশনের পরিপত্র অনুযায়ী বাজারে যেই দর চলমান, সেটার হিসাবেই ব্যয় প্রাক্কলন করতে হয়। এদিকে পিইসির আগের প্রস্তাবিত ডিপিপিতে দেখা যায়, সেখানে অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ৭৭ হাজার টাকা ধরা হয়েছিল।
৩৭৮ জনের বিদেশ প্রশিক্ষণ
এই সংকটের সময়েও প্রকল্পটিতে ৩৭৮ জনের বিদেশ প্রশিক্ষণে ৬৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। একেকজনের বিদেশ প্রশিক্ষণে খরচ পড়ছে ১৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা। যদিও প্রথমে এই প্রকল্পে বিদেশ প্রশিক্ষণে ১৩৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক-৭ রেজওয়ানুল হক বলেন, ‘শিক্ষকদের আধুনিক ও নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে দক্ষ করতে বিদেশে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেখানে তারা দেড় মাসের মতো প্রশিক্ষণ পাবেন।’
অভিজ্ঞতা থাকার পরও পরামর্শক
প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ১০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পের ভবন নির্মাণের কাজ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নিয়মিত কাজ। এই কাজে আদৌ কোনো পরামর্শকের প্রয়োজন নেই বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।
প্রকল্পের প্রস্তাব সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগে দুটি নতুন কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ (টিটিটিসি) প্রতিষ্ঠা করা হবে, ঢাকায় বিদ্যমান টিটিটিসি এবং বগুড়ায় বৃত্তিমূলক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ভিটিটিআই) সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ করা হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ২৩৫ জন কারিগরি শিক্ষক ও কর্মকর্তার উচ্চস্তরের প্রশিক্ষণ এবং বিদেশে উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ প্রদান করবে।
প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯ কোটি টাকা। যার মধ্যে সরকার দেবে ২০৯ কোটি আর এডিবি দেবে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যদিও প্রথম প্রস্তাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। পিইসি সভায় ৪৪৯ কোটি টাকা ব্যয় কমানো হয়েছে তারপরও ব্যয় বেশি। প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে বিটিইবি ২০২৯ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।