রানা আহমেদ: ঢাকার অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বুক চিরে বয়ে গেছে ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ শুভাঢ্যা খাল। এক সময় এ খাল দিয়ে নৌকা চলত; ছিল নানান জাতের মাছ। এখান থেকেই আসত কৃষিজমির পানির জোগান। দখল-দূষণ আর অব্যবস্থাপনায় বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী গুরুত্বপূর্ণ খালটি মৃতপ্রায়।
চর কালীগঞ্জ থেকে রাজেন্দ্রপুর বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত শুভাঢ্যা খাল এখন ভূমিদস্যুদের দখলে। খালে পানি আনতে গত এক দশকে একাধিকবার উদ্ধার ও পুনর্খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী নানান প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু ফলাফল দৃশ্যমান হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, খাল রক্ষায় অর্থের বড় অংশ কাগজ-কলমে ব্যয় দেখানো হলেও মাঠ পর্যায়ে কিছুই হয়নি। খালের নাম ভাঙিয়ে বরাদ্দের টাকা লুট হয়েছে।
সেই শুভাঢ্যা খাল পুনরুদ্ধারে আবার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩১৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে শুরু হয়েছে পুনর্খনন ও সংস্কার কাজ। গতকাল মঙ্গলবার এ কাজের উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
প্রকল্পের পর প্রকল্প
১৮ বছর আগে ২০০৭ সালে প্রথম শুভাঢ্যা খাল পুনরুদ্ধারে বড় পরিসরে কাজ শুরু করেছিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সে সময় খালের প্রায় তিন কিলোমিটার অংশে ১৮৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। খালের পানি প্রবাহও স্বাভাবিক হয়। তবে কয়েক বছর পর আবার ভরাট হতে থাকে। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালের শেষ দিকে উপজেলা প্রশাসন খালটিকে আগের অবস্থায় ফেরাতে উদ্যোগ নেয়। তখন ব্যয় হয় ৫৫ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। ২০১৫ সালে এসে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে খালের দুই তীরের কিছু অংশে ‘ব্লক’ বসায়। তখন খননের পাশাপাশি অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করা হয়।
২০১৬ সালে উপজেলা প্রশাসন দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি ও কাবিখা প্রকল্পের আওতায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে খালের বর্জ্য অপসারণ করে। অবশ্য এর অনেক আগে ২০০০ সালে খাল পুনর্খননের জন্য ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আর কাজ শুরু হয়নি।
বারবার উদ্বোধন, হয় না কাজ
খালটির খননকাজ ঘটা করে অন্তত তিনবার উদ্বোধন হয়। ২০১৮ সালের ১২ জুন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০ কোটি টাকার কাজের দায়িত্ব নেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাজি মুজিবুর রহমান। কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
২০২৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ৪ কিলোমিটার খাল খননকাজের উদ্বোধন করেন। ওই কাজের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ইউএনও ফয়সাল বিন করীম। ৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কিছুদিনের মধ্যে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এর পর খাল খননে ৩ কোটি ১৭ লাখ ৫৯ হাজার টাকা অনুমোদিত হয়। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর গাফিলতির কারণে কাজ হয়নি। ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাল পুনর্খনন কাজের উদ্বোধন করেন। তখন ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হলেও কাজ শুরু হয়নি।
সর্বশেষ গতকাল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩১৭ কোটি টাকার প্রকল্পে খালটির পুনর্খনন কাজ শুরু হলো। অবশ্য গত ১০ বছরে উপজেলা প্রশাসন খাল রক্ষায় একাধিক নৌকাবাইচসহ নানা সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করেছে।
২০০০ সালে খাল পুনর্খননের জন্য ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকার যে প্রকল্প পাস হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সে প্রকল্পই কাটছাঁট করে ৩১৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে কাজ শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে খাল খননের কাজ করবে সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। প্রকল্পে খননের পাশাপাশি পাড় বাঁধাই, ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ রয়েছে। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ৬০ বছরের বাসিন্দা তৈয়ব আলী বলেন, ‘কতবার শুনলাম, খাল খনন হবে। কোটি কোটি টাকা খরচ হলো। তবুও খালে পানি আসে না। এবার যদি কিছু একটা হয়।’
সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে
গতকাল ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের ঝাউবাড়ি এলাকায় খালের তীরে পুনর্খনন কাজের উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি কেরানীগঞ্জের প্রতিবেশী সিরাজদীখানের সন্তান। সিরাজদীখান থেকে অনেকবার শুভাঢ্যা খাল দিয়ে নৌকায় ঢাকা গিয়েছি। কেরানীগঞ্জে ভূমিদস্যুতা বেশি। সবাই মিলে তাদের প্রতিহত করতে হবে।’
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘ভূমিদস্যুরা খালের দুই পাড় দখল করে নেওয়ায় এটি ছোট হয়ে গেছে। অতীতে অনেকবার খাল খনন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। দুষ্টচক্রের কারণে খননকাজ হয়নি। খাল রক্ষায় এলাকাবাসীকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘শুভাঢ্যা খালের ঢাকার বুড়িগঙ্গা থেকে শুরু করে ধলেশ্বরী নদীর মোল্লাবাজার পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার ভরাট হয়ে গেছে। এ খালকে আবার বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর সঙ্গে সংযুক্ত করতে চাই। এবার কাজের কোনো ঘাটতি রাখা হবে না।’
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘খালটি উদ্ধারে আগের সরকার ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছিল। বর্তমান সরকার প্রথম পর্যায়ে ৩১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে খালটি খনন করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনবে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। আগের মতো নৌ চলাচল করবে। ১৬ মিটার ওয়াকওয়ে হবে। খালের পাড়ে ৬ হাজার ৬০টি গাছ লাগানো হবে।’
নতুন অধ্যায়
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় খালটি রক্ষা প্রকল্পকে নতুন অধ্যায় বলছেন স্থানীয়রা। একই সঙ্গে তারা আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি নিয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
শুভাঢ্যার ঝাউবাড়ি এলাকার বাসিন্দা অজি উল্যাহ বলেন, গত ১০ বছরে যতবার এ খালের বর্জ্য অপসারণ ও খননের কাজ হয়েছে, ততবার এসব পাড়ে রাখা হয়েছিল। বৃষ্টির পানিতে সব বর্জ্য ও মাটি আবার খালে পড়েছে। আমরা আগের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি চাই না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পুনর্খনন করলে হবে না। খালটির দুই পাড় দখলমুক্ত, বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয়দের সচেতন করা জরুরি। নইলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়েও ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।