কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: সেবা নয়, দুর্নীতি-নৈরাজ্যের অভয়ারণ্য
স্টাফ রিপোর্টার:
গরীব মানুষের চিকিৎসার শেষ আশ্রয়স্থল ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’। কিন্তু এটি যখন স্বাস্থ্যসেবার আড়ালে দুর্নীতি, লুটপাট আর নৈরাজ্যের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় তখন আর কিছুই করার থাকেনা। কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নামক সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা কার্যক্রম যেন এক ধরনের প্রহসন, ডাক্তার ও কর্মচারীরা যেন নবাব সিরাজদৌলার বংশধর। যে যার মতো অফিস করছেন, রোগি মরলো কি বাঁচলো তার খোজ কেইবা রাখে, গরিব রোগীদের সঙ্গে চলছে নির্মম প্রতারণা। এক কথায়, এটি কোন হাসপাতাল নয়, যেন একটি অত্যাচারখানা’। নেই তদারকি, নেই জবাবদিহিতা, চলছে কমিশন বানিজ্যের হলিখেলা। তবে এখানকার ডাক্তাররা প্রাইভেট ক্লিনিকে বিশাল দায়িত্বশীল, হেডমে পরিপূর্ন। ভিজিট ফি ৫শ থেকে হাজার টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান কর্মকর্তা ডা. আব্দুল মোকাদ্দেসের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে রোগিদের অভিযোগের শেষ নেই্। হাসপাতালের অফিসিয়াল সময় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা হলেও কেউ আসেন ১১টায়, কেউ ১২টায়, কেউ আসেই না। কেউ নিজের ব্যবসা সামলাচ্ছেন, আবার কেউ সরকারি অফিসিয়াল সময়েই চেম্বারে বসে রোগী দেখছেন। এত বড় নৈরাজ্য দেখেও নিরব সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
গরিব রোগীদের জন্য এই হাসপাতাল যেন এক বিভীষিকা। অনেকে ধারদেনা করে কিংবা কোন সম্পদ বিক্রি করে হলে কম খরচের আশায় এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন, কিন্তু হাসপাতালে ঢুকতেই পড়তে হয় দালাল ও দুর্নীতির ফাঁদে। চিকিৎসা তো দূরের কথা প্রথমেই মুখোমুখি হতে হয় প্রতারণার। কমিশনের লোভে রোগির হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় এক বোঝা টেষ্ট। অথচ টেষ্ট করা মতো যন্ত্রপাতি নেই এই হাসপাতালে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, একাধিক ধাপে প্রতারণা চলছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ঘিরে। অনেক ডাক্তার অফিস সময়েই বেসরকারি চেম্বারে বসেন। নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে কমিশন চুক্তি রয়েছে। নির্দেশনা দেওয়া হয় “এই ফার্মেসিতে যাও”, “ওই ল্যাবে করাও” এ যেন অপরাধ নয়, বরং নিয়ম! প্রেসক্রিপশন নিয়েও চলে টানাটানি। দালাল চক্র সব চেম্বারে ঘাপটি মেরে বসে আছে, কারো নিস্তার নেই।
সুত্র জানায়, কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো: আব্দুল মোকাদ্দেস এই হাসপাতালে যোগদানের পর থেকেই অনিয়ম দুর্নীতির মাত্রা প্রকট আকার ধারন করেছে। জবাবদিহিতা না থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে বিগত অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে খরচ দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া ডা. মোকাদ্দেসের সঙ্গে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি ও বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনেষ্টিক সেন্টারের মালিকদের সাথে কমিশন বানিজ্যের চুক্তি থাকায় তাঁর নির্দেশে সরকারি ওষুধ উধাও করে দিয়ে চিকিৎসকরা কোম্পানির ওষুধ ও অপ্রয়োজনীয় যত টেষ্ট লিখে দিচ্ছেন অসহায়-গরিব রোগীদের প্রেসক্রিপশনে। চুক্তি অনুযায়ী ওষুধ লেখা হচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করতে ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিদের টানাহেঁচড়ায় পড়েন রোগীরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের শয্যাগুলো ধুলা-ময়লায় ঢেকে গেছে। টয়লেটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। অনেক জায়গায় ময়লা-আবর্জনা জমে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। শৌচাগারের বেসিনগুলো ভাঙাচোরা। অথচ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে বছরে লাখ লাখ টাকা খরচের ভাউচার দেখান ডা: মোকাদ্দেস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্টাফ জানান, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো: আব্দুল মোকাদ্দেস যোগদানের পর থেকে সাধারণ রোগীকে হয়রানি, ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্মচারীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ভাতার টাকা আত্মসাৎ ও আনুতোষিক ভাতা নয় ছয় করে আসছেন। এমনকি ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাম্পেইন, খুদে চিকিৎসক ক্যাম্পেইন ভাতা ও মাঠকর্মীদের সম্মানি ভাতা পর্যন্ত নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিচ্ছেন। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে চাকুরী হারানোর ভয়ভীতি দেখানো হয়। কোন জবাবদিহিতা না থাকায় তিনি কাউকেই তোয়াক্কা করেন না। ৫ আগষ্টের পর বেপরোয়া গতিতে চলছে তার লুটপাটের স্টীমরোলার।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে খরচ দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব খাত থেকে ৪৫ লাখ ১১ হাজার ৩৩৭ টাকার বিল উত্তোলন করেছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। এর মধ্যে পেট্রোল-তেল খরচ বাবদ ৫ লাখ ২৮ হাজার, পরিছন্নতা বাবদ ৪ লাখ ৯৬ হাজার, বিজ্ঞাপন বাবদ ৩৪ হাজার, চিকিৎসা সরঞ্জাম বাবদ ২৯ লাখ ৫৪ হাজার, কম্পিউটার সামগ্রী বাবদ ৩ হাজার ৮০০, স্ট্যাম্প-সিল বাবদ ১৪ হাজার, মনিহারি বাবদ ৯৩ হাজার, মোটরযান মেরামত বাবদ ৯৯ হাজার, যন্ত্রপাতি মেরামত বাবদ ৭০ হাজার, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ ২ হাজার ৫৩৭, আসবাব মেরামত বাবদ ৩২ হাজার, অফিস সরঞ্জাম মেরামত বাবদ ৫০ হাজার, কম্পিউটার মেরামত বাবদ ৪৬ হাজার, আসবাব ক্রয় বাবদ ৪৪ হাজার ও প্রকাশনা বাবদ ৪৫ হাজার টাকা তোলা হয়েছে।
স্টাফদের দাবি, ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে বেশির ভাগ টাকা আত্মসাৎ করেছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: মোকাদ্দেস। এসব বিষয় সঠিক তদন্ত হলে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে।
চিকিৎসা নিতে কণা খানম বলেন, চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে পাঁচটি ওষুধ ও ৪টি টেষ্ট লিখে দিয়েছেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে শুধু একটি ওষুধ দেওয়া হয়েছে। বাকি ওষুধের কথা জানতে চাইলে বলা হয়েছে, সরবরাহ নেই। বাইরে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেতে বলেছে। বাইরে বের হওয়ার সময় একদল লোক তাঁকে দেওয়া চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছবি তুলে রেখেছে।
কাওসার আহম্মেদ নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, “আমি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি দুই দিন, কিন্তু ডাক্তার ঠিকমতো আসেন না। খাবারও ঠিকমতো দেয় না, আর যেটুকু দেয়, তা খাওয়ার যোগ্য না।
নিরব নামে এক রোগি বলেন, দুপুর ১২টায় রোগি হাসপাতালে গিয়েছি , তখনও দেখি ডাক্তার আসেনি। জরুরী বিভাগের একজন বলেন, দ্রুত রোগিকে ঢাকায় নিয়ে যান এখানে কোন চিকিৎসা হবে না।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল মোকাদ্দেস। তিনি বলেন, রেফারেন্স নিয়ে কথা বলবেন। আমার অফিসে আসেন, আপনি কোথাকার সাংবাদিক, আমার বাড়ী গোপিবাগ, আমার কাছে বড় বড় সাংবাদিক আছে।