মনিরুল হক সোহাগঃ
খুনী হাসিনা পালানোর পরে ক্ষমতার পালা বদলে হাসিনার সহযোগিরা অনেকেই ভোল পাল্টোনো শুরু করছে। টাকার বিনিময়ে জামাত-বিএনপি সহ গুড়াগাড়া বিভিন্ন দলের ঢুকে পড়ছে। যেখান দিয়েই সুযোগ পাচ্ছে ঢুকে পড়ছে বিভিন্ন পরিচয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভাগিয়ে নিচ্ছেন লোভনীয় জায়গা। যেখানে গেলে কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে যাবেন আঙুল ফুলে কলা গাছ। এমনই অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর লালমাটিয়ায় অবস্থিত এভাররোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান সোহাগের বিরুদ্ধে। তিনি হাসিনার সাবেক একান্ত সচিব-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর সহযোগী হিসেবে লিকুর অবৈধ টাকায় গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। লিকুর প্রভার বিস্তার করে এভাররোজ স্কুলের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ থাকার পরেও কেউ কিছু করতে পারেনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আনিসুর রহমান সোহাগ একজন জাল সনদধারী অধ্যক্ষ। বন্ধুর অনার্স উত্তীর্ণের সনদ জাল করে বছরের পর বছর চাকরি করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। একপর্যায়ে রাজধানীর লালমাটিয়ায় অবস্থিত এভাররোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ পদেই বসে যান। আর এই স্কুলের শেয়ার বিক্রি নামে হাতিয়ে নেন কোটি কোট টাকা। কেউ টাকা ফেরত চাইলে ভয় দেখাতেন লিকু ভাইয়ের। কেউ মামলা করলে পুলিশ তার কথার বাইরে কাজ করতো না। আছে লিকুর ভাই, কে তার কোন পশম ছিড়বে। তাইতো বন্ধুর অনার্সের সাটিফিকেট নকল করে নিজের সার্টিফিকেট বানিয়ে আরেজনের স্কুল দখলে নিয়ে প্রধান শিক্ষক বনে গেলেও কেউ তার কিছুই করতে পারেনি।
ভুয়া শিক্ষক সোহাগ হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ও বিতর্কিত ইবাইস (ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম) থেকে এমবিএ ও বিবিএ’র ডিগ্রি অর্জনের তথ্য জুড়ে দেন তার ফেসবুক প্রোফাইলে। শুধু তাই নয়, বিপুল বিত্ত বৈভবেরও মালিক তিনি। আয়কর নথিপত্রে দিয়েছেন ভুয়া ঠিকানা। গোপন করেছেন কোটি কোটি টাকার আর্থিক লেনদেন। এমন সব গুরুতর অপরাধের হোতা আনিসুর রহমান সোহাগের বাড়ি ঝালকাঠির নলসিটি উপজেলায়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইউজিসির (বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুখ বলেছেন, অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ইবাইস ইউনিভার্সিটির নাম নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী বৈধ সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল না থাকায় ইবাইসের সনদের আইনগত বৈধতা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই যেখানে অবৈধ, সেখানে সার্টিফিকেট এমনিতেই বৈধ নয়।
ইবাইস ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট দিয়ে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত) নামের একটি প্রতিষ্ঠান হতে বিশেষায়িত কোর্স ‘মাস্টার অব এন্ট্রাপ্রেনরশিপ ইকোনমিকস’ সম্পন্ন করেন আনিসুর রহমান সোহাগ। বিষয়টি জানতে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, এন্ট্রাপ্রেনরশিপ অব ইকোনমিকস-এ মাস্টার্স কোর্স করে শুধুমাত্র ইকোনমিকসে মাস্টার্স লেখা যাবে না, কোথাও লিখলে সেটি মিথ্যা হবে।
ঢাকা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক অধ্যাপক আবুল মনসুর ভূঁইয়া বলেন, আসলে কখনো প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা অন্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দেখা হয়নি। এভেরোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ যদি নিজেই জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন তাহলে এটা ফৌজদারি অপরাধ। অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত করা হবে।
অনার্সের সনদই জাল: ২০০৫ সালে আনিসুর রহমান সোহাগ একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি নেন। সেখানে এসএসসি ও এইচএসসির সঙ্গে অনার্স উত্তীর্ণের একটি সাময়িক সনদের সত্যায়িত ফটোকপি জমা দেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত সনদের সিরিয়াল নং-০০২৫৭৪৪, রোল নং-০৫২১৩৭, রেজিস্ট্রেশন নং-৮১৪১৮৩, সেশন ১৯৯৯-২০০০ এবং বিষয় লেখা আছে, ব্যাচেলর অব সাইন্স, ‘বোটানি’, বিএম কলেজ, বরিশাল। ২০০৪ সালের ১৮ অক্টোবর কন্ট্রোলার লেখার নিচে স্বাক্ষর রয়েছে ওই সনদে। সাময়িক সনদে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে আনিসুর রহমান সোহাগকে। সংশ্লিষ্ট ওই সনদের বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মশিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি এই সনদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বলেন, এই সনদের সঙ্গে মূল সনদের কোনো মিল নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানানো হয়, হুবুহু তথ্যের সঙ্গে আরেকজন শিক্ষার্থীর সনদের মিল পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ে ওই শিক্ষার্থীর নাম দেওয়ান হাফিজুর রহমান। তার প্রকৃত অনার্সের সাময়িক সনদে বিষয় ‘ব্যাচেলর অব সাইন্স, ‘ম্যাথমেটিক্স’।
আনিসুর রহমান দেওয়ান হাফিজুর রহমানের তথ্যউপাত্ত ও বিষয়- ‘বোটানি’ লিখে জাল করেছেন। সংশ্লিষ্ট সনদের শিক্ষার্থী দেওয়ান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আনিসুর রহমান সোহাগকে তিনি চেনেন। তার বাড়িও একই এলাকায়। তবে সনদ জাল হওয়ার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
যেভাবে স্কুলের অধ্যক্ষ: উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে কিভাবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মালিক ও অধ্যক্ষ হয়ে গেলেন তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য। লালমাটিয়ায় অধুনালুপ্ত পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ আব্দুল্লাহ জামানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ২০১৬ সালে গুলশান হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার পর সরকার সারা দেশে পিস স্কুল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এ সময় স্কুল বাঁচাতে আব্দুল্লাহ জামান এই প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সহায়তা চান। ওই সময় আনিসুর রহমান সোহাগের সহায়তায় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে ‘রেডব্রিজ স্কুল’ নামে পিস স্কুল চালুর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে চেষ্টা তাদের ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে সেটি এভাররোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সঙ্গে একীভূত হয়। ‘জুজুর ভয়’ দেখিয়ে আব্দুল্লাহ জামানকে দূরে সরিয়ে তার অংশ লিখে নেওয়া হয়। প্রথমেই ওই স্কুলের অধ্যক্ষ নিলুফার ইয়াসমিনকে চাকরিচ্যুত করে নিজের জায়গা করে নেন আনিসুর রহমান সোহাগ।
এভাররোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মিরপুর শাখার উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন জেড এম রানা নামের এক ব্যবসায়ীকে। ২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সোহাগের ফাঁদে পড়েন রানা। মিরপুর শাখায় রানাকে প্রাথমিক দেয়া হলেও কাগজপত্রে কোন কিছু বঝিয়ে দেয়া হচ্ছে না। সোহাগের নামে মামলা করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না রানা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেডএম রানা বলেন, পুলিশের সহায়তায় নিজের লোকজনকে ভুয়া বাদী সাজিয়ে তিন সপ্তাহের ব্যবধানে তিনটি মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে জেল খাটিয়েছেন। অথচ মামলাগুলো সাজানো প্রমাণ হলেও এর পেছনে থাকা দুর্বৃত্তদের বিচার হয়নি। এমনকি আমাকে জেলহাজতে পাঠিয়ে শাখা স্কুলটি দখলে করে নেন সোহাগ।
আয়কর নথিতে সম্পদের তথ্য গোপন: আনিসুর রহমান সোহাগ বিপুল অঙ্কের টাকা গোপন করতে আয়কর নথিতে ঠিকানাও গোপন করেছেন। এছাড়া কোটি টাকা খরচ করে গ্রামের বাড়িতে করেছেন দোতলা বাড়ি। রাজধানীতে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের ২২’শ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ব্যক্তিগত গাড়ি, ২২ বিঘা জমিতে ‘যমুনা ব্রিকস’ নামে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের ইটভাটা এবং পিলারস পাবলিকেশন্স নামে প্রকাশনীও আছে তার। অথচ ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া তেমন কিছুই উল্লেখ নেই আয়কর নথিতে। স্ত্রীর নামে টিআইএন থাকলেও সংশ্লিষ্ট সার্কেলে আয়কর দাখিলের তথ্য নেই। বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাসহ স্কুল থেকেই বছরে তিনি নেন প্রায় ৬০ লাখ টাকা। ২০২১ অর্থবছরের আয়কর নথিতে দেখানো হয়েছে আট লাখ ৪০ হাজার টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে ৯ লাখ ১৯ হাজার ৬০০ টাকা হলেও, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে আট লাখ ৯৬ হাজার টাকা। অথচ ২০২২ সালে ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকায় ৭৫ শতক জমি কিনেছেন বলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আয়কর নদিতে উল্লেখ করেছেন। মেঘনা ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় তার নিজের অ্যাকাউন্টে ৯০ লাখ টাকা লেনদেন হলেও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আরেক অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট দাখিল করে লেনদেন দেখিয়েছেন মাত্র ১২শ’ টাকা। ধানমন্ডি এলাকার সংশ্লিষ্ট ট্যাক্স সার্কেলে ব্যক্তিগত টিআইএন চালু করে সেটি ২০১৬ সালে সার্কেল-ও এ স্থানান্তর করেন। তবে এখন আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন সার্কেল-২৩১ এ। সেখানে ঢাবির কাঁটাবন মার্কেটের আর্ট অ্যান্ড গিফটের একটি দোকানকে বর্তমান ঠিকানা হিসাবে দেখানো হয়েছে। অথচ গত পাঁচ বছর ধরে স্থায়ীভাবে নিজের ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন এই আনিসুর রহমান সোহাগ।
তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সার্কেল-২৭৭ এ তার আরেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এক্সপ্রিমেন্টাল এক্সপ্রেশন্স বাংলাদেশ লিমিটেডের আয়কর রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব এক প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আয়কর না দিতে ভুয়া অডিট রিপোর্ট দেখিয়ে সোহাগ নিজের স্বাক্ষর করা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্টেটমেন্টে উল্লেখ করেছেন ‘৩০ জুন ২০১৯’ পর্যন্ত ব্যবসা শুরু হয়নি। অথচ আইএফআইসি ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় থাকা এ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ২০১৯ সালের আগে থেকে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১৯ কোটি টাকা। ব্যবসার শুরু হতেই এ ব্যাংক হিসাবটি সোহাগের একক স্বাক্ষরে পরিচালিত হয়েছে।
জাল-জালিয়াতির বিষয়টি বেরিয়ে এলে এই সোহাগ নিজের অপকর্মের আদ্যোপান্ত স্বীকার করে এ প্রতিবেদকের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেন, অনেক কষ্ট করে ক্যারিয়ারটা গড়েছি। আমাকে বাঁচান। দীর্ঘদিন লেখাপড়া করতে পারিনি। বন্ধুর সনদ জাল করেছেন কেন জানতে চাইলে বলেন, আমাকে ক্ষমা করেন। আপনি যা বলবেন সব মেনে নেব।