মোঃ আহসানউল্লাহ হাসানঃ
“ডেসটিনি স্টাইলে বসতবাড়ী সিটি নামে পিংকি’র প্রতারণা: হাওয়ার উপরে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা” শিরোনামে সাপ্তাহিক জনকথায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে প্রতারক পিংকির প্রতারনার পার্টনার এশিয়ান টিভির সাংবাদিক জিএম শাহজাহান। তিনি কোন কালে এশিয়ান টিভিতে সাংবাদিকতা করেছেন তাহার হদিস না থাকলে দাম্ভিকতা সহ হুমকি দিতে কার্পন্যতা করেননি। এশিয়ান টিভিতে খোজখবর নিয়েও শাহজাহানের হদিস মেলেনি। তবে হাসিনা যুগে এশিয়ান টিভির মালিক হারুন অর রশীদ ৫০ হাজার থেকে দুই তিন লাখ টাকায় এশিয়ান টিভির আইডি কার্ড বিক্রয় করে অসংখ্য সাংবাদিক বানিয়েছে। শাহজাহান সেই গ্রুপেরই কোন একজন হতে পারেন বলে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে। শাহজাহান প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিক হলে একজন প্রতারকের ব্যবসায়িক পার্টনার হওয়ার কথা না। ডেসটিনি স্টাইলের প্রতারক পিংকির ব্যবসায়িক পার্টনার পরিচয়ে সাংবাদিক শাহজাহান হুমকি দিয়ে বলেন, নিউজ করে সব জায়গায় দিয়ে দেন।
পাঠকের জানার জন্য বিস্তারিত তুলো ধরা হলোঃ ‘স্বপ্ন আপনার বাস্তবায়ন আমাদের’ শ্লোগানকে সমানে রেখে ১লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে মাসে ৪/৮হাজার টাকা লভ্যাংশ প্রদানের অফার দিয়ে রাজধানীর বনানীর মতো ভিআইপি এলাকায় উন্নতমানের অফিস খুলে ডেসটিনি স্টাইলে প্রকাশ্য দিবালোকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পিংকি-রেজাউল দম্পতি। এই দম্পতি দীর্ঘ ১যুগেরও বেশী সময় ধরে বিভিন্ন কোম্পানীর নামের সাথে মিল রেখে এক একটা আলাদা কোম্পনীর নাম দিয়ে মানুষের সাথে প্রতারনা করে আসছে। এই জুটি একাধিকবার প্রতারনা মামলায় জেলও খেটেছে। তবে কোন কিছুই তাদেরকে দমাতে পারেনি। তাদের প্রতারনার স্টাইল দেখলে বুঝা যায়, তারা মঙ্গল গ্রহের এলিয়েনদের কাছ থেকে প্রতারণার উপরে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতারক জুটি পিংকি-রেজাউল ২০১৪ সালে পূর্বাচলে অবস্থিত মেগা স্যাটেলাইট সিটি নামের একটি হাউজিং কোম্পানীর বনানীস্থ অফিসে মার্কেটিংয়ের কাজ শুরু করেন। কিন্তু দুই/তিন মাস পরে পিংকি নিজেকে ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ঘোষনা দিয়ে তার স্বামী রেজাউল করিম সহ তাদের গুরুখ্যাত মহাপ্রতারক সালাউদ্দিন আহম্মেদ ও হাসিবুল ইসলাম জয়ের সাথে পার্টনারশিপে “মেগা স্যাটেলাইট ট্রান্সপোর্ট লিঃ( সময় ট্রান্সপোর্ট)” নামে একটি কোম্পানী গড়ে তুলেন।
কোম্পানীটি গড়ে তোলা পরে মার্কেটিং এজেন্ট দ্বারা মেগা স্যাটেলাইট সিটির প্লট দেখানো টোপ দিয়ে বিত্তবানদের অফিসে ডেকে আনে। কখনো কখনো মক্কেলকে নিজস্ব গাড়িতে করে প্লট দেখাতে পূর্বাচলে নিয়ে যেতেন। রঙ্গিণ স্বপ্ন দেখিয়ে পূর্বাচলে নতুন শহরের বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরিয়ে দেখাতেন। বলেতেন, স্যার আপনে এই প্লটটি নিতে পারেন, দক্ষিন দিকের বাতাস এসে এই দিক দিয়ে উত্তর দিকে চলে যাবে। এয়ারপোর্ট থেকে ৩শ ফিট রাস্তা দিয়ে চলে আসবেন। এইদিক দিয়ে সিলেট-চট্টগ্রাম যেতে পারবেন। পূর্বাচলে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়, হসপিটাল, স্টেডিয়াম, ১শ তলা বানিজ্য টাওয়ার হবে। এখানে এমপি-মন্ত্রী, সচিব, সেনাবাহিনী, পুলিশ-র্যাব সহ সরকারের বড় বড় লোকেরা প্লট কিনেছে। আপনি এখন ১০ লাখ টাকা দিয়ে একটি প্লট কিনলে ৫বছর পরে এটার দাম হয়ে যাবে ৫ কোটি টাকা। তাছাড়া এখন ১০ লাখ টাকায় প্লট বুকিং দিলে মাসে মাসে ১লাখ টাকা করে লাভই পাবেন। ১০ মাসেই তো আপনার টাকা উঠে যাবে। কোম্পানী এই টাকায় ট্রান্সপোট বিজনেসে গাড়ী কিনবে। এক একটি গাড়ী থেকে প্রতি মাসে ভাড়া আসবে দেড় লাখ টাকা। আপনাকে লভ্যাংশ দেয়া হবে লাখে ১০ হাজার আর কোম্পানীর থাকবে ১লাখ ৪০ হাজার। আপনাকে ১০ হাজার না, ২০হাজার দিলেও তো কোন লস নেই কোম্পানীর। বরং আমি আপনার জন্য সুপারিশ করে লাখে ১৫ হাজার করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবো। তবে আমাকে মাসে ১৫শ টাকা হারে কমিশন দিতে হবে। এখানেই টোপের খেলা শেষ। মক্কেলরা এমন টোপে পড়েই পিংকি-রেজাউল চক্রের হাতে তুলে দেয় লাখ লাখ টাকা। এক মক্কেলের টাকা নিয়ে আরেক মক্কেলকে মাসে মাসে লাভের টাকা প্রদান করে মক্কেলের আস্থা আরো বাড়িয়ে দেয়ায় হয়। এভাবে ১০ মক্কেল দ্বারা ১০০ মক্কেল, ১০০ মক্কেল দ্বারা হাজার মক্কেল টেনে এনে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ৬/৭ মাসের ব্যবধানে। এরপরে চম্পট।
২০২১ সালে উত্তরা পূর্ব থানার অফিসার ইন্চার্জ মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম জানান, একটি প্রতারক চক্রের মুলহোতা সালাউদ্দিন আহম্মেদ, রেজাউল করিম ও পিংকি আক্তার “মেগা স্যাটেলাইট সিটি লিঃ” ও “মেগা স্যাটেলাইট ট্রান্সপোর্ট লিঃ” নামক কোম্পানীর আড়ালে এমএলএম ব্যবসার নামে তিনশত কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা ১৪মার্চ-২০২১ তারিখে এই থানায় একটি মামলা করেন। মামলার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে এজাহার নামীয় আমাসী মুলহোতা সালাউদ্দিন আহম্মেদ, রেজাউল করিম ও পিংকি আক্তারকে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়।
সুত্র জানায়, এই চক্রটি দীর্ঘদিন জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এসে এখন আরো বেশী শক্তিশালী হয়ে মাঠে নেমেছে। এখন তারা প্রতিলাখে ৩০ লভ্যাংশ প্রদানের অফার দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এরা বিশ্বাস করে ৬মাস ব্যবসা রানিং রাখতে পারলে টাকার অভাব হবেনা। জামিন নিতে আর কয় টাকা লাগবে। বাদীর টাকা ফেরত দিলেই তো মামলা শেষ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আবার নতুন স্টাইলে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ী ২নাম্বার রোডের ন্যাম ভবন নামীয় ৬নাম্বার বাড়ীর ডি-৫ ফ্ল্যাটে ‘বসতবাড়ী সিটি’ নামে পিংকি-রেজাউল দম্পতির এমএলএম কোম্পানির চাকচিক্যময় অফিস। ‘বসতবাড়ী সিটি’ নামে পিংকি-রেজাউল দম্পতির মালিকানাধীন কোন আবাসন কোম্পানীর অস্তিত্ব বাংলাদেশের কোথায় খুজে পাওয়া যায়নি। যদিও প্রকল্পের লোকেশন পূর্বাচল নতুন শহরে যাওয়ার পথে সিলেট-পূর্বাচল নতুন মহাসড়কের পাঁচদোনা-ডাঙ্গা। তবে এখানে গেলে ‘বসতবাড়ী পূর্বাচল সিটি ডেভেলাপমেন্ট লিঃ নামের অন্য আরেকটি কোম্পানীর সাইনবোর্ড চোখে পড়বে। যেই কোম্পানীর মালিকের নাম সাইফুল ইসলাম এন্ড এসোসিয়েটস। অফিসের ঠিকানা খিলক্ষেত নিকুঞ্জ এলাকায়।
এদিকে ‘বসতবাড়ী সিটি’র চেয়ারম্যান পিংকি আক্তার এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর তার স্বামী রেজাউল করিম। ছেলে মো: আরিফুল ইসলামকে বানিয়েছে অর্থ পরিচালক (ক্যাশিয়ার)। মক্কেলের মাধ্যমে বিনিয়োগ করাতে পারদর্শী হওয়ায় পারভিন আহম্মেদকে বসিয়েছেন ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদে। কোটি টাকার বিনিয়োগ করলে চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিবেন যেকাউকে। আর এটাই পিংকির ডেসটিনি কৌশল। মক্কেলরা প্লট দেখতে চাইলে ‘বসতবাড়ী পূর্বাচল সিটি ডেভেলাপমেন্ট লিঃ প্রকল্পের প্লট দেখানো হয়। সত্যিকার্থে কেউ প্লট কিনতে চাইলে তাকে ‘বসতবাড়ী পূর্বাচল সিটি ডেভেলাপমেন্ট লিমিটেডে’র প্লট কিনে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ‘বসতবাড়ী পূর্বাচল সিটি ডেভেলাপমেন্ট লিমিটেডের মার্কেটিং এজেন্টের সাথে আগেই কমিশন ভিত্তিক চুক্তি করে নিয়েছে পিংকি-রেজাউল দম্পতি।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সুত্র জানায়, কোন ডেভেলপার যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ ব্যতীত কোন রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করিলে কিংবা অননুমোদিত রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের বিজ্ঞাপন প্রচার বা বিক্রয় করিলে অনূর্ধ্ব ২ (দুই) বৎসর কারাদন্ড অথবা অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবার বিধান রহিয়াছে।
বসতবাড়ী সিটি’র চেয়ারম্যান পিংকি আক্তার বলেন, সারা বাংলাদেশেই আমি বসতবাড়ী সিটি বানাবো, গাজীপুর নারায়নগঞ্জে আমার প্রকল্প আছে। ওয়েবসাইটে প্রকল্পের ঠিকানা দেয়ার প্রয়োজন মনে করি নাই। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আছে কিনা এমন প্রশ্নে বলেন-‘না, অনুমোদন নেই’। তবে জয়েন্ট স্টক করা আছে। আমার স্বামী রেজাউল করিম ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং ছেলে মো: আরিফুল ইসলাম ফাইন্যান্স ডিরেক্টর এটা ঠিক আছে।
১ম পর্বে এই প্রতিবেনটি প্রকাশের পরই এশিয়ান টিভির সাংবাদিক পরিচয়ে জিএম শাহজাহান জনকথার নির্বাহী সম্পাদকের মোবাইলে কল দিয়ে হুমকি দেন। বিষয়টি এশিয়ান টিভির কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলে তারা জানান, শাহজাহান এর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।