লুটপাটে বেহাল বিএমডিএ

লুটপাটে বেহাল বিএমডিএ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট:

ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকের উপকারে গড়ে ওঠা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বেহাল। খাল খনন থেকে শুরু কেনাকাটা-সবখানে লুটপাটের বিস্তর অভিযোগ। এসব নিয়ে অডিট আপত্তি উঠলেও তা আমলে নেয় না কর্তৃপক্ষ। ফলে লুটপাট বাড়ছে। মুখ থুবড়ে পরার আশঙ্কায় বিএমডিএ। শুষ্ক মৌসুমে চাষিদের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ২০১৯-২০২৪ অর্থবছরে ৩০০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে খাল খনন করে বিএমডিএ। চাষিরা বলছেন, নামেমাত্র খাল খননের মাধ্যমে টাকার অপচয় করেছে বিএমডিএ। বিএমডিএ সূত্র জানায়, জলাবদ্ধতা দূর করতে ও নদীর পানি সেচের কাজে লাগাতে বিএমডিএ রাজশাহীর চার উপজেলায় খাল খননে প্রকল্প নেয়।

২০২২ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে শাহাপুর-কাটাখালী-ছত্রগাছা পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৯২ কিলোমিটার খালটি এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অনেকের বাড়ি ভেঙে গেছে। কাটাখালী মোল্লাপাড়ার নাসির উদ্দিন জানান, অপরিকল্পিতভাবে খাল খনন করায় অনেকের বাড়িঘর ভেঙে গেছে। অনেকে ঝুঁকির মধ্যে আছেন। জলাবদ্ধতা দূর হয়নি। উল্টো মানুষ বসতি হারিয়েছে। এখন মানুষ দৈনন্দিন কাজের বর্জ্য ফেলছেন ওই খালে। নাটোরে খাল খনন করা হলেও তাতে বর্ষা মৌসুম ছাড়া পানি থাকে না।

যে সেতু করা হয়েছে, সেটি দিয়ে গরুরগাড়িও নেওয়া যায় না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের খালটি ৩০ ফুট থাকার কথা থাকলেও সেটি ৮-১০ ফুটে গিয়ে ঠেকেছে। প্রকল্প পরিচালক নাজিরুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেছেন, কাজ প্রথমে ঠিকভাবে করেননি ঠিকাদার। পরে কাজ ভালো হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৪ লাখ তালগাছের হদিস নেই। দরপত্র ছাড়াই কোটেশনে কেনাকাটা, তাও নিম্নমানের। কেনাকাটায় পকেট পড়ছে প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি)। কৃষকদের যেসব সেবা দেওয়ার কথা, তা দিচ্ছে না বিএমডিএ। টাকা চুরির প্রমাণ লোপাটে দেওয়া হয়েছিল অফিসে আগুন। নিজ স্কেলের চেয়ে বেশি বেতন নিয়েছেন ৭৩ কর্মকর্তা। সেচ থেকে প্রকল্প, সবখানে চলে লুটপাট।

স্থানীয়রা জানান, কোথাও কোথাও গর্ত খুঁড়ে তালবীজ লাগানো হয়েছিল। আবার কোথাও কোথাও না লাগিয়েই তড়িঘড়ি করে বীজ ফেলে পালিয়ে যান ঠিকাদার। ঠিকমতো বীজ না লাগানোর কারণে পবা উপজেলা দর্শনপাড়ার খাড়িধার এলাকায় ঠিকাদারের লোকজন গ্রামবাসীর তোপের মুখে পড়েছিল। বরেন্দ্র এলাকায় তালবীজ রোপণ কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক ও বিএমডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই প্রকল্পের সব তালগাছ নেই। কোথায় আছে আর কোথায় নেই তাও বলা যাচ্ছে না। তবে বিভিন্ন উপজেলার কমিটি গণনা শেষে প্রতিবেদন দেওয়ার পর বিল পেয়েছেন ঠিকাদাররা। শুধু তালগাছ নয়, কেনাকাটায় অনিয়ম করে শত কোটি টাকা পকেটে ঢুকিয়েছেন প্রকল্প পরিচালকরা। প্রকল্প পরিচালক শহিদুর রহমান শত কোটি টাকার প্রকল্পে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করায় তা ফেটে যায়। এ নিয়ে তদন্ত হয়। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী শহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কাজ না করেই বিল প্রদান এবং নিম্নমানের পাইপ ও গেট ভাল্ব কেনাকাটায় নয়ছয় করা হয়েছে। হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা।

বিএমডিএ-এর ‘ভূগর্ভস্থ সেচনালা বর্ধিতকরণের মাধ্যমে সেচ এলাকার সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ প্রকল্পে বরাদ্দ আছে ৩২৯ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিচালক শহিদুর রহমান সংশ্লিষ্ট প্রকল্প সম্প্রসারণের জন্য ১০০ কোটি টাকার ইউপিভিসি পাইপ এবং গেট ভাল্ব কিনেছেন। প্রকল্প পরিচালকের নিম্নমানের পাইপ ও গেট ভাল্ব কেনার বিষয়টি ওই প্রকল্পের মনিটরিং কর্মকর্তা বিএমডিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল লতিফের নজরে আসে। এরপর আবদুল লতিফ প্রকল্পের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাহী পরিচালকের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। এ ছাড়া রাইজার ভাল্বযে কেনায়ও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ১৫ কেজির ভাল্বের পরিবর্তে কেনা হয়েছে ১২ কেজি ওজনের। প্রকল্পটিতে গভীর নলকূপ স্থাপনের ক্ষেত্রে এমএস হাউজিং পাইপ এবং এসএস স্টেইনার ব্যবহারের বিষয়টি শিডিউলে উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক শহিদুর রহমান নিম্নমানের প্লাস্টিকের হাউজিং এবং স্টেইনার দিয়ে গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন। সম্প্রতি কাজের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে শহিদুর রহমানকে তার অফিস কক্ষে গিয়ে মারধরও করেন ঠিকাদারদের একটি অংশ।

প্রকৌশলী শহিদুর রহমান বলেন, প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগটি ভিত্তিহীন। কাজ না করে বিল দেওয়ার অভিযোগটিও বানোয়াট। এ ছাড়া নিম্নমানের পাইপসহ অন্য মালামাল কেনায় অনিয়মের যে অভিযোগটি করা হচ্ছে তাও মিথ্যা। বেতন স্কেল জালিয়াতি করে ধরা পড়েছেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ৭৩ কর্মকর্তা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারি এই সংস্থাাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এ সংস্থার ৭৩ জন প্রকৌশল কর্মকর্তা জালিয়াতি করে নিজেরাই বাড়িয়ে নিয়েছেন নিজেদের বেতন স্কেল। সংস্থার হিসাব বিভাগকে ম্যানেজ করে মাসের পর মাস বাড়তি বেতন তুলছিলেন এরা। এই কান্ডে জড়িত ছিলেন সহকারী প্রকৌশলী ১৩ জন, সহকারী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) আটজন, সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী ৩২ জন ও উপসহকারী প্রকৌশলী ২০ জন। তারা বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অঞ্চল ও জেলার মাঠপর্যায়ে কর্মরত। বিষয়টি ২০১৭ সালে বাণিজ্যিক নিরীক্ষায় প্রথমে ধরা পড়ে। বিএমডিএর পানির ফাঁদে পড়ে যখন কৃষকদের আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে, তখন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যস্ত অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটে। ২০১৮-২০১৯ থেকে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে একাধিক প্রকল্পে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্য উঠে আসে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কৃষি ও পরিবেশ অডিটে। বরেন্দ্রর অনিয়মের ফিরিস্তিও বেশ লম্বা। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হিসাব শাখা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অডিট আপত্তি উঠেছে চার অর্থবছরে দরপত্র ছাড়াই পণ্য কেনায় প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা, রাজস্ব ক্ষতি প্রায় ১২ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকে ডিপোজিট ১০০ কোটির বেশি, চেক টেম্পারিংয়ে আত্মসাৎ ৫৫ লাখের বেশি, সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি প্রায় ৫৩ লাখ টাকা, অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য কেনা ৩৩ লাখ টাকা, পাতকুয়া নির্মাণে অনিয়ম সাড়ে ৯ কোটি টাকা, অনিয়মিত ব্যয় প্রায় ৭ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পে নিয়ম না মেনে সোয়া ১১ কোটি টাকা খরচ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পে প্রায় ৬৭ লাখ টাকার অনিয়ম, বিভিন্ন মালামাল কেনা ও মেরামত কাজে অনিয়ম ৬৯ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছর ছাড়াও বিএমডিএর গোদাগাড়ী জোনে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৮০টি চেক জালিয়াতির ঘটনায় প্রকৌশলী জি এফ এম হাসানুল ইসলাম ও আনোয়ার হোসেনের জড়িত থাকার বিষয়টিও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বিএমডিএ চেয়ারম্যান ড. এম আসাদুজ্জামান জানান, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই এসব অডিট আপত্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি বিষয়গুলো জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। ইতোমধ্যে একজন প্রকল্প পরিচালককে বদল করা হয়েছে।

 

More News...

খাঁটি আওয়ামীলীগার সামিউলের অঢেল সম্পদ

অবৈধ সম্পদে লালেলাল ইঞ্জিঃ জামাল