স্বপ্নছায়া গ্রীন সিটি’র প্রতারনা: প্লট ব্যবসার নামে এক ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে স্বপ্নছায়া গ্রীন সিটি। গায়েবী প্লটের ডিজাইন দেখিয়ে লোভনীয় অফারে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন রাষ্ট্রীয় অনুমোদনহীন এই হাউজিং কোম্পানিটি
স্টাফ রিপোর্টারঃ
প্লট ব্যবসার নামে এক ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে স্বপ্নছায়া গ্রীন সিটি। গায়েবী প্লটের ডিজাইন দেখিয়ে লোভনীয় অফারে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন রাষ্ট্রীয় অনুমোদনহীন এই হাউজিং কোম্পানিটি। জমির মালিদের অজান্তে শতশত একর কৃষি জমির উপরে প্লটের লে-আউট ডিজাইন বানিয়ে বড় বড় সাইনবোর্ড, চমকপ্রদ লিফলেট, বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচারনা চালানো হচ্ছে ফেসবুক ইউটিউবে। যেন দেশে আইন-কানুন বলতে কিছুই নেই।
ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসনের দায়মুক্তি সনদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া আইনানুগ বিধান থাকলেও এগুলো না নিয়েই আকর্ষনীয় বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে সাধারন মানুষের কাছে প্লট বুকিং দিচ্ছে এই হাউজিং কোম্পানিটি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বপ্নছায়া গ্রীন সিটি ওরফে স্বপ্নছায়া প্রোপার্টিজ লিমিটেড নামে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে কোন হাউজিং কোম্পানির অনুমোদন নাই। আরজেসি ও ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্সই তাদের একমাত্র পুজি।
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পশ্চিম পাশে সিরাজদিখান উপজেলাধীন কুচিয়ামোড়া-সৈয়দপুর রোড সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী আড়িয়াল বিল ঘিরে শতশত একর কৃষি জমিতে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে প্লট বুকিং এর নামে গ্রাহকের সাথে প্রতারনা সহ অন্যের জমি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখলের কৌশলে মেতে উঠেছে এই প্রতারক চক্রটি। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে চাকচিক্যময় অফিস ও বিজ্ঞাপন যোগে সর্বশান্ত করার আয়োজন সম্পন্ন করা হলেও এ সংক্রান্তে দায়িত্বশীল দপ্তর গুলোকে কোন তদারকি করতেই দেখা যায় না। লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পায় না ভুক্তভোগিরা। জয়েন্ট স্টক হতে নামের ছাড়পত্র নিয়েই চলছে কথিত আবাসন কোম্পানিটির প্লট বানিজ্য। কথিত এই ব্যবসার পরিধি-পরিচিতি বাড়াতে বিভিন্ন মাধ্যমে মন ভোলানো বিজ্ঞাপন প্রচার করেন। এতে করে ঢাকাসহ স্থানীয় অনেক ক্রেতা প্লট ক্রয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন। বিশেষ করে প্রবাসীরা এ চক্রের বড় টার্গেট। প্রবাসীদের অনলাইনে সংযোগ করে প্লট ক্রয়ের স্বপ্ন দেখানো হয়। জয়েন্ট স্টক রেজিষ্ট্রিশন নেয়ার সময় কোম্পানির নিকট প্রকল্পের নিজস্ব ৩শত বিঘা জমির মালিকানা দাবি করলেও সরেজমিনে কথিত কোম্পানিটির মাত্র এক/দেড় বিঘা জমি আছে বলে জানায় স্থানীয়রা।
পদ্মা সেতু ও ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ার পর মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান-শ্রীনগর উপজেলা সংশ্লিষ্ট আড়িয়াল বিল ও তার আশপাশের এলাকায় জমির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সেখানে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে অন্তত ৭০টির মতো ভুমিদস্যু প্রতারক চক্র। এরমধ্যে স্বপ্নছায়া গ্রীনসিটির চেয়ারম্যান বাতেন সরকার অন্যতম। কৃষিজমিতে লাগিয়েছেন বড় বড় সাইনবোর্ড। চলছে বালু ভরাটের কাজ। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আবাসন প্রকল্পগুলো অবৈধ। কোনো হাউজিং কোম্পানিকে এখনও এখানে প্রকল্প গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
আড়িয়াল বিলে গড়ে ওঠা অবৈধ আবাসন প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে ভূমি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি দেওয়ার সুপারিশ করেন কমিটির সদস্যরা। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে অবৈধ আবাসন প্রকল্পের তালিকা করতে বলা হয়। জেলা প্রশাসন স্থানীয় এসিল্যান্ড দ্বারা তালিকাও দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবাসন প্রকল্প গ্রহণে হাউজিং কোম্পানিকে সাতটি শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কোম্পানির নামে ১০ একর জমি থাকতে হবে, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র থাকতে হবে, জেলা প্রশাসনের দায়মুক্তি সনদ নিতে হবে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আড়িয়াল বিলের বিভিন্ন এলাকায় যারা আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন, তারা কেউই ওই সাত শর্ত পূরণ করেননি।
অন্যদিকে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, সরকার ঘোষিত জলাধার যে কোনো পরিস্থিতিতেই ভরাট করা নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ওই জলাধারে কাঠামো নির্মাণ, জমির উন্নয়ন, বালু বা কাদা উত্তোলন করে পানির গতিপথ বন্ধ, পরিবর্তন অথবা পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারেন না।
কিন্তু এসব আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ঘেঁষে আড়িয়াল বিল সহ পার্শ্ববতী এলাকা কুচিয়ামোড়া, নিমতলা, হাসাড়া, ষোলঘর ও কেওয়াটখালী মৌজায় আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড লাগিয়েছে অন্তত ৭০টির মতো হাউজিং কোম্পানি। এগুলোর মধ্যে স্বপ্নছায়া গ্রীন সিটি, পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেড, রয়েল প্রপার্টিজ, ধরিত্রী, শান্তি নিবাস, দখিনাচল, মেরিন গ্রুপ, মৈত্রী ইকো ভিলেজ, গুলশান সিটি, পদ্মা সিটি হাউজিং, স্বপ্নধারা, বীরতারা সিটি, মেরীল্যান্ড সিটি, আমিন মোহাম্মদ সিটি, বিক্রমপুর মর্ডান সিটি, নিমতলা হাউজিং, বাতায়ন ও বারিধারা হাউজিং অন্যতম। কোম্পানি গুলোর ভুমিদস্যুতা চরম আকার ধারন করেছে। তারা বেপরোয় গতিতে কৃষিজমিতে বালু ভরাট করছে। কেউ কেউ কৃষকের জমি ভাড়া নিয়ে তাতে আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। যেন দেখার কেউ নেই।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পশ্চিম কুচিয়ামোড়া এলাকায় অন্তত ২শ একর কৃষি জমির উপরে প্লটের লে-আউট ডিজাইন বানিয়ে দখল শুরু করেছে স্বপ্নছায়া গ্রীন সিটি। কোম্পানিটি সেখানে একটি সাইট অফিসও বানিয়েছে। পুরোদমে চলছে বালু ভরাটের কাজ।
এব্যাপারে কোম্পানীর এডমিন রাজু বলেন, লে-আউট প্ল্যানের পুরো জমি আমাদের নয়। এতো জমি নিয়ে সবাই কি ব্যবসা চালু করতে পারে। আমরা প্ল্যানে দেখাচ্ছি ঠিক আছে, ভবিষ্যতে কিনে নিবো।