ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়নের সকালেই ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। রাতে ব্যাগও গুছিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু মধ্যরাতে সচিবালয়ে আগুনের খবরে ডাক পড়ে তার। আগুন নেভাতে গিয়ে জীবন প্রদীপ নিভে যায় বেপরোয়া ট্রাকচাপায়। বুধবার মধ্যরাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে এ ঘটনা ঘটে।
দায়িত্ব পালনে তেজগাঁও থেকে ছুটে গিয়েছিলেন স্পেশাল ইউনিটের এই সদস্যরাও। যুক্ত হয়েছিলেন আগুন নেভানোর কাজে। পানির পাইপ সংযোগ দিতে সচিবালয়ের রাস্তার উল্টো পাশে যাওয়ার সময় বেপরোয়া গতির একটি ট্রাক ধাক্কা দেয় নয়নকে। মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি সোয়ানুরকে। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সহকর্মীরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সকালেই ছুটিতে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল সোয়ানুরের। কিন্তু মাঝরাতে ডাক পড়ায় ঘুম থেকে উঠেই যোগ দিয়েছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালনে। সেখানে প্রাণ হারিয়ে এখন বাড়ি ফিরছে তার নিথর দেহ। দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে সোয়ানুরের মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়।
তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার রাজিব বলেন, আমরা বুধবার একসঙ্গে খাবার খেয়েছি। একসঙ্গে ভলিবলও খেলেছি। সম্ভবত রাত ২টা ৪০ মিনিটে সাইরেন বেজে ওঠে। তাৎক্ষণিক ড্রাইভার ১০ জন সদস্য নিয়ে মিনিবাসে করে এখানে আসেন। আমরা ১০ মিনিট পরে আসি। নয়ন পানির পাইপ কাঁধে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। হঠাৎ একটি দ্রুতগতির ট্রাক পেছন থেকে তাকে ধাক্কা দিলে সে রাস্তায় পড়ে যান। পরে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢামেকে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
নয়ন ছিলেন পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। কৃষক বাবা আক্তারুজ্জামানের সব ভরসা ছিল তাকে ঘিরেই। অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলের চাকরি দিয়ে অনাগত দিনগুলো সুখে-শান্তিতে কাটাবেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ হওয়ার আগেই ঘাতক ট্রাক কেড়ে নিল সব।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের ছড়ান আটকুনিয়া গ্রামের আক্তারুজ্জামান ও নার্গিস দম্পতির একমাত্র ছেলে সোয়ানুর জামান নয়ন। এক বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ছোট নয়ন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নয়নের পরিবার নদীভাঙনের শিকার। নিজস্ব জমিজমা বলতে তেমন কিছু নেই। অনেক কষ্টে একমাত্র ছেলেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। ২০২২ সালে তার চাকরি হয়। ছেলের চাকরিতে পরিবারে একটু সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন টিকল না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এখন পরিবারটি দিশাহারা।
ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ বাবা আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ অনেক ভারী। আমার অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে। সবকিছু শেষ হয়ে গেল।’
সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ জানার পর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তার মা নার্গিস বেগম। সন্তানবিয়োগের ব্যথা সইতে না পেরে নিজের বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন মা।
চোখের জলে বিদায় : বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ৫ মিনিটের দিকে ফায়ার ফাইটার নয়নের (২৪) জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরের প্রাঙ্গণে। দেশের পতাকায় মোড়ানো ফায়ার ফাইটার নয়নের মরদেহ যখন ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর প্রাঙ্গণে রাখা হয় তখন এক শোকের ছায়া নেমে আসে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের চোখ তখন অশ্রুসিক্ত। জানাজার আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ফায়ার সার্ভিসে সদর দফতরে উপস্থিত হয়ে ফায়ার ফাইটার নয়নকে শ্রদ্ধা জানান।
ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরে জানাজায় অংশ নিতে আসা নয়নের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম বলেন, আমার ভাই এভাবে চলে গেল যে আর ফিরে আসবে না কখনো। তার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল আমার কিন্তু আর শেষ দেখা হলো না। তার এই অকাল মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না। এত যুদ্ধ করতে গিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধ শুরুর আগেই সেই নির্মমভাবে দুর্ঘটনায় নিহত হলো। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন কাজ করছিল তখন যদি পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিত তা হলে আমার ভাইকে এভাবে আর মরতে হতো না। আমরা আশা করব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে যাতে করে নয়নের মতো আর কারও মৃত্যু না হয়।