নিজস্ব প্রতিবেদক: মব জাস্টিস (উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার) যেন কোনোভাবেই থামছে না। যখন-তখন কয়েকজন দলবল নিয়ে ফিল্মি স্টাইলে ভাঙচুর, তল্লাশি ও লুটপাট করে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও নীরব ভ‚মিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে দোষারোপ করছে। দ্রুত কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছে। ছাত্রনেতারা বলছেন, তাদের নতুন দল মাঠে পুরোপুরি মুভমেন্ট করতে পারলে মব জাস্টিস অনেকাংশে কমে আসবে। আর সরকার বলছে, তারা মব জাস্টিস ও মোরাল পুলিশিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
গত বছর আগস্টে পটপরিবর্তনের পর থেকেই ‘মব’ ও ‘মব জাস্টিস’ শব্দগুলো বারবার ফিরে ফিরে আসছে। বিভিন্ন ঘটনায় আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে দেখা গেছে উত্তেজিত জনতাকে। সবশেষ মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর গুলশানে মব জাস্টিস করে একটি বাসায় তল্লাশির নামে তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাট করে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। এর আগে শনিবার ঢাকার লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে দুই তরুণীর ধূমপান করা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়, যা নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে।
বুধবার মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৭৯২ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৫ জন।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান সময়ের আলোকে বলেন, আমরা সবসময় নেতাকর্মীদের বোঝাচ্ছি। সাংগঠনিকভাবে বিভিন্ন কমসূচি, কর্মশালা করে কাউন্সেলিং করছি। তারপরও মব জাস্টিসে কেউ জড়িত থাকলে সাংগঠনিকভাবে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। এ বিষয়ে দল থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এখানে সরকারের দায় আছে। তাদের আরও কঠোর হতে হবে। মবে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে। সরকারের প্রধান দায়িত্ব দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। তিনি মনে করেন, এসব মব জাস্টিস বন্ধ করতে জবাবদিহিমূলক সরকার জরুরি।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সময়ের আলোকে বলেন, মব জাস্টিসে আমাদের নেতাকর্মীরা জড়িত নয়। আর যেখানে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে দল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছি। এটি একমাত্র বিএনপিই করেছে। সরকারকে সহযোগিতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি চাই বলেই আমরা এটি করছি। বিএনপির এই নেতা মনে করেন, দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। যখন জনগণের মাঝে কোনো আশার আলো না থাকে তখন এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। সরকার মূল বিষয় নির্বাচন থেকে অগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে পড়ে আছে। এ জন্য এখন কেউ সেইফ (নিরাপদ) নয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, সরকারকে আমরা সবসময় বলছি; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করতে জোর দিচ্ছি। ইতিমধ্যে মব বন্ধ করতে সরকার কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। দেখা যাক সামনে পরিস্থিতি কতটা উন্নতি হয়। এগুলো সরকারের পলিসিগত ডিসিশনের বিষয়। তারা কীভাবে কতটা কঠোর হবে; তারাই সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা সহযোগিতা করছি।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম সময়ের আলোকে বলেন, আমরা সবসময় এর বিরুদ্ধে ভ‚মিকা নিয়েছি। সবাইকে সভা, সমাবেশ ও সাংগঠনিক কর্মসূচির মাধ্যমে কাউন্সেলিং করছি। মব জাস্টিস গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কাক্সিক্ষত নয়। এটি বন্ধ করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। মব জাস্টিস বন্ধ করতে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করতে হবে।
মব জাস্টিস বন্ধ না হওয়ার পেছনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে দায়ী করেন জাতীয় নাগরিক পাটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার।
সময়ের আলোকে তিনি বলেন, মব বন্ধ করতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ। সরকার একটি মব জাস্টিসেরও সঠিক বিচার করেনি। আমাদের দলের কেউ মবের সঙ্গে জড়িত নয়। সংগঠনের নির্দেশনা আছে আওয়ামী লীগের দোসর কাউকে পেলে যাতে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। আমরা সারা দেশে কিছু কাজ করছি। ধীরে ধীরে মাঠে রান করলে এসব ঘটনা অনেক কমে আসবে। তরুণরা রাজনীতির ছাতায় চলে আসবে। আর দেশ-বিদেশ থেকে উসকানিদাতারাও তো ওত পেতে বসে আছে।
প্রায় একই কথা বলেন নাগরিক পাটির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক সাদ্দাম হোসেন। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, রাজনীতি সবচেয়ে বড় স্টেইক (অংশীজন) বিএনপি ও জামায়াতের। তাদের ভ‚মিকা জোরালো করতে হবে। আমরা মব জাস্টিস বন্ধ করতে ভ‚মিকা রাখছি সাধ্যমতো। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। আমরা তার পদত্যাগের দাবিতে কর্মসূচি দিচ্ছি। আমরা অভ্যন্তরীণভাবে আরও গুছিয়ে সামনে এই ইস্যুতে কর্মসূচি দেব।
দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন, সন্ত্রাস ও মব সন্ত্রাসে জনজীবনে আতঙ্ক বেড়ে যাওয়ায় তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। দলটির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বুধবার এক বিবৃতিতে এ ক্ষোভ জানান। তারা বলেন, সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে উপদেষ্টারা সংকটের কথা স্বীকার না করলেও দিন দিন জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা বেড়েই চলেছে। এর দায় অন্তর্বর্তী সরকার এবং তার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেই নিতে হবে।