পালিয়ে থেকে সম্পত্তি বেচতে ক্রেতা খুঁজছেন নসরুল হামিদ

পালিয়ে থেকে সম্পত্তি বেচতে ক্রেতা খুঁজছেন নসরুল হামিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: জ্বালানি খেকো হিসেবেই দেশের মানুষের কাছে পরিচিতি কুড়িয়েছেন স্বৈরাচারী সরকারের পলাতক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।

যদিও নসরুল হামিদের পৈতৃক ব্যবসা ছিল রিয়েল এস্টেটের। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, বিপু ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের পরিমাণ অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান নসরুল হামিদ বিপু। বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন তিনি।

তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হামিদ গ্রুপের অধীনে হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, হামিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড, হামিদ ইকোনমিক জোন, হামিদ ফ্যাশন লিমিটেড অ্যান্ড হামিদ সোয়েটার লিমিটেড ও হামিদ এগ্রো লিমিটেডের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। হামিদ গ্রুপের রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ব্র্যান্ড হলো ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ’। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে রয়েছেন নসরুল হামিদ বিপুর ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু। বিপুর মতো তিনিও বর্তমানে পলাতক।

রাজধানীর গুলশান ক্লাবের উল্টো পাশে ২০০ কোটি টাকা মূল্যের এক বিঘার বাগানবাড়ির রয়েছে বিপুর। এটি বিক্রির জন্যেও ক্রেতা খুঁজছেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই প্লটটি বিক্রি করতে বড় বড় ব্যবসায়ীদের ধরছেন নসরুল হামিদ।

রাজধানীর মাদানী এভিনিউর ১০০ ফুট রাস্তার পাশেও নসরুল হামিদের পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে। এ জমিও বিক্রি জন্য ক্রেতা খুঁজছেন তিনি।

সূত্র জানায়, বড় আয়তনের এই দুইটি জায়গা এখন পর্যন্ত বিক্রি করতে না পারলেও গুলশান, বনানী ও নিকেতন এলাকার একাধিক ছোট প্লট ও বাড়ি এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন নসরুল হামিদ। সম্পত্তি বিক্রির ওই টাকার বড় অংশই তিনি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে নিয়ে গেছেন।

জানা যায়, নসরুল হামিদ তার বেশির ভাগ সম্পত্তিই বিক্রি করে দেবেন। সেজন্য ক্রেতা খুঁজছেন তিনি।

সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে বক্তব্য জানতে নসরুল হামিদ সঙ্গে একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড সূত্রে জানা যায়, ‘নসরুল হামিদ বিপু ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের পরিমাণ অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা।

হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের আওতায় রাজধানীর কেরানীগঞ্জে প্রিয়প্রাঙ্গণ-১ ও প্রিয়প্রাঙ্গণ-২ আবাসিক এলাকাটিতে নগদ ও কিস্তিতে প্লট বিক্রি করছে হামিদ গ্রুপ।

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তার এমপি-মন্ত্রীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তাদের বেশিরভাগ ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকা দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে গেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দেড় দশকে দেশের বিদ্যুৎ খাতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ হয়। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলার ১২২ টাকা দরে) এ বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল ২০০৯-১০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত এক যুগে বিদ্যুৎ খাতে ২৮ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার (৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের এ তথ্য নসরুল হামিদ নিজেই ২০২২ সালে জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন।

দেশে গত দেড় দশকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে গণহারে কয়েক ডজন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ আইনের অধীনে। এ আইনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই দরকষাকষির মাধ্যমে প্রকল্প অনুমোদনের সুযোগ রাখা হয়েছিল। শেখ হাসিনা নিজেই এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকায় নসরুল হামিদ একাই পুরো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সর্বেসর্বা ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আইনের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই তিনি বিভিন্ন প্রকল্প ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিতেন।

বিদ্যুৎ খাতের একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, গত এক দশকে দেশে যতগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন পেয়েছে, তার প্রত্যেকটির বিনিময়ে নসরুল হামিদকে শতাংশের হিসাবে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ খাত থেকে তার প্রাপ্ত ঘুষের পরিমাণই হবে হাজার কোটি টাকার বেশি।

বিদ্যুৎ খাতের পাশাপাশি এলপিজি ও এলএনজি আমদানিতেও বিভিন্নভাবে ভাগ বসিয়েছিলেন নসরুল হামিদ। ২০২১ সালে দেশে এলপিজি আমদানিতে বৃহৎ একটি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল সরকার। বিপুল বিনিয়োগের এ প্রকল্পটি বাগিয়ে নিতে সিঙ্গাপুরে নিজের মামার নামে নসরুল হামিদ একটি শেল কোম্পানি খুলেছিলেন। ওই কোম্পানিসহ আরও দুই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ভিটল ও জাপানের মারুবেনি করপোরেশনকে ৩০৫ মিলিয়ন ডলারের এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তির জন্য নির্বাচিত করতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন তিনি। গুরুতর এ দুর্নীতির বিষয়টি ওই সময় প্রকাশ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নসরুল হামিদকে পিছিয়ে আসতে হয়।

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ৯৮টি ব্যাংক হিসাবে ৩ হাজার ১৮১ কোটি টাকা অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে এরই মধ্যে নসরুল হামিদ বিপুর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিপু ছাড়াও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার স্ত্রী সীমা হামিদ ও ছেলে জারিফ হামিদের নামেও পৃথক মামলা করেছে সংস্থাটি। গত ডিসেম্বরে দায়েরকৃত এসব মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছে।

নসরুল হামিদের বিরুদ্ধে গত বছরের ২২ আগস্ট দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। ওইদিন তার প্রতিষ্ঠান হামিদ গ্রুপে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। এ সময় ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ’ নামে ভবনের ভেতর থেকে বেশ কয়েকটি ভল্টে থাকা নগদ অর্থ, বৈদেশিক মুদ্রা এবং অস্ত্র-গুলিসহ অন্যান্য সামগ্রী জব্দ করা হয়।

উল্লেখ্য, নসরুল হামিদ ২০১৪ সাল থেকে ১০ বছরেরও বেশি সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বিগত দেড় দশকে সরকারের সবচেয়ে বেশি অর্থের অপচয় ও লুটপাট হয়েছে এ মন্ত্রণালয় ঘিরে। নিজের ব্যবসা ও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে নসরুল হামিদ বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানেও তার সম্পত্তি ও ব্যবসা রয়েছে।

More News...

ঋণের টাকা লুটের যত আয়োজন

সব রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় স্বর্ণ