স্বপ্ন বিক্রির নামে দু:স্বপ্নের কারখানা স্বপ্নভুমি আবাসন

স্বপ্ন বিক্রির নামে দু:স্বপ্নের কারখানা স্বপ্নভুমি আবাসন

স্বপ্ন বিক্রির নামে দু:স্বপ্নের কারখানা স্বপ্নভুমি আবাসন

নাজনীন নাহারঃ
স্বপ্নভুমি-স্বপ্নের আবাসন, ভুমি প্রপার্টিজ লিমিটেডের একটি হাউজিং প্রকল্প। রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে স্বপ্ন বিক্রির নামে দু:স্বপ্নের কারখানা খ্যাত স্বপ্নভুমি নামের এই হাউজিং প্রকল্পটি। নিজেদের মালিকানাধীন অল্প কিছু জমির সাথে অন্যেদের শতশত একর ফসলি জমি, সরকারী খাস জমি, জলাশয় দখলে নিয়ে প্লটের ডিজিটাল লে-আউট ডিজাইন বানিয়ে গ্রাহকদের অভিনব প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক মিলন হাসান। রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএস এর মতো আভিজাত এলাকায় চোখ ধাঁধানো অফিসে বসে ফেসবুক, ইউটিউব সহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রতারণার কৌশল বাস্তবায়নে বিলবোর্ড, আকর্ষণীয় অফারের বিজ্ঞাপনে গ্রাহকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে এই কোম্পানিটি। তবে কোম্পানিটির রাষ্ট্রীয় কোন অনুমোদন না থাকলেও উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন অবসর প্রাপ্ত আর্মি অফিসার কর্নেল মহিউদ্দিন মো: জাবেদ। কিন্তু কোম্পানিটির প্রকাশিত ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের নামটি গোপন রাখা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে । রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্রাশেই গড়ে উঠছে স্বপ্নভুমি আবাসন প্রকল্পটি। আধুনিক শহরের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রকল্পের ম্যাপ আর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে আগামী ১০ বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনায় মাঠে নেমেছে কোম্পানিটি। গুটিকয়েক শেয়ারহোল্ডারের নিজস্ব অর্থায়নে অল্প কিছু জমি কিনে বাকি জমি দখল এবং বার্ষিক ভাড়ার চুক্তিতে বালু ভরাট করে চোখধাঁধানো সাইনবোর্ড টাঙিয়ে আকর্ষণীয় দামে প্লট বিক্রির নামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। কারন কোম্পানীর নামে নির্ধারিত পরিমানে জমির মালিকানা থাকলেই কেবল কোম্পানির অনুমোদন দিয়ে থাকে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ অথবা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃক রাজউক। আর পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হলে পরিবেশের ছাড়পত্র দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এরূপ আরো ২৩টি রাষ্ট্রীয় দপ্তরের অনুমোদন নিয়েই হাউজিং ব্যবসা পরিচালনার বিধান রয়েছে যেকোন হাউজিং কোম্পানির। কিন্তু এসব আইনের তোয়াক্কা না করেই ঘুষের বিনিময়ে হাউজিংগুলোকে একধরনে দায়মুক্তি ছাড়পত্র দিয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলো। যেকারনে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এসিল্যান্ড ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এসব প্রতারণা প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তোলে না। টাকার বিনিময়ে তারাও একধরনের নিরব সহযোগিতা চালিয়ে যায়। আবার টাকা দেয়া বন্ধ করলে অভিযান চালিয়ে সাইনবোর্ড ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ার দৃশ্যও দেখা যায় মাঝে মধ্যে।

এককালীন মূল্য পরিশোধে বিশাল ছাড়, ফ্রি ডিনার সেট, স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষলেই লাখ টাকা পর্যন্ত মূল্য ছাড়-এমন চমৎকার বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢাকা শহরের নামিদামি হোটেলে কয়েকদিন পর পর আবাসন মেলা বসিয়ে গ্রাহকের কাছে সহজ কিস্তিতে প্লট বুকিং দিয়ে থাকেন প্রতারক মিলন হাসান। এতে প্রলুব্ধ হয়ে ফাঁদে পা দিয়েছে অনেক মানুষ। প্রতারণা বুঝতে পেরে অনেক গ্রাহক টাকা ফেরত চাইলে টালবাহানা করেন মালিকপক্ষ।

৩,৫,৬ ও ১০ কাঠার প্লট বুকিং দিলেই ১লাখ টাকা মূল্য ছাড়, আছে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তির সুব্যবস্থা। এভাবেই তাদের টার্গেটকৃত গ্রাহকের নিকট থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনায় কাজ করছে স্বপ্নভুমি আবাসন। কিন্তু ১০/১৫ বছর পর গ্রাহকদের কোথায় কীভাবে কোন প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তা একমাত্র তারাই জানেন। কারণ গ্রাহকরা যেসকল ডুকমেন্টের ওপরে নির্ভর করে টাকা জমা দিচ্ছেন সেই ডুকমেন্টের ভিত্তিতে হাজার বছরেও ফেরত পাবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। আবাসন ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা বলছেন, এই নিয়মে প্লট পাবে না ৯৮ শতাংশ গ্রাহক।

জাতীয় গৃহায়ন কর্তপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা নারায়নগঞ্জ জেলা প্রশাসন কারও অনুমতি নেয়নি স্বপ্নভুমি আবাসন। নেই আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার মতো পর্যাপ্ত জমি। তবুও শুধুই প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন হোটেলে একক আবাসন মেলার আয়োজন করে এই প্রতিষ্ঠানটি। একঝাঁক সুদর্শন তরুণ-তরুনী দিয়ে একধরনের হানিট্যাপ কৌশলে মানুষের স্বপ্ন নিয়ে এই কোম্পানির অভিনব প্রতারণা, অনুমোদন ছাড়াই প্লট বিক্রির বাহারি বিজ্ঞাপন নিয়ে মানুষের ক্ষোভের যেন শেষ নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্বপ্নভুমি হাউজিং’ পরিবেশ ছাড়পত্র গ্রহণ তো দূরের কথা এখন পর্যন্ত আবেদনই করেনি। তবে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না-এ ব্যাপারে সদুত্তর না দিয়ে বলেন, বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া খুবই কষ্ঠসাধ্য ছিলো। কারন বেশীভাগ আবাসন ব্যবসায়ীরাই ভুমিদস্যুতার সাথে সরাসরি জড়িত। তারা আইন কানুনের কিছুই মানে না। শুধুই প্রভাব খাটিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বপ্নভুমি আবাসন প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, স্বপ্নভুমি হাউজিংয়ের নিজস্ব জমির পরিমাণ মাত্র কয়েক বিঘা। যেসব জমির ওপর সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে এবং বালুভরাট করা হয়েছে তার বেশীভাগই অন্যের কাছ থেকে মাসিক ভাড়ায় নেয়া ও কৌশলে দখল করা। কারণ আবাসন প্রকল্প বানাতে গেলে যে পরিমাণ জমি প্রয়োজন তা কোম্পানির নেই। মূলত তারা চটকদার বিজ্ঞাপনে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে এ প্রতারণা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

স্বপ্নভুমি সিনিয়র এডমিন সরিফুল ইসলাম বলেন, তাদের কাগজপত্র সব কিছুই ঠিকঠাক আছে। এমডি স্যার ঢাকা বাইরে আছে, তিনি আসলে বিস্তারিত বলতে পারবেন।