নির্বাচনী হাওয়ায় মুন্সীগঞ্জ-১
ভুল সিদ্ধান্তেই ঘটতে পারে অঘটন
মোঃ আহসানউল্লাহ হাসানঃ
মুন্সীগঞ্জের তিনটি সংসদীয় আসনের মধ্যে শ্রীনগর-সিরাজদিখান উপজেলা নিয়ে গঠিত মুন্সীগঞ্জ-১ আসন। এই আসনটির এক বিশাল রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই এই আসনটি বিএনপির দুর্গ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। মাঝখানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ এই আসনটি ছিনতাই করে নিয়ে অন্তত দেড়যুগের বেশী সময় গুম, খুন দখল, চাঁদাবাজি, হামলা মামলা চালিয়ে বিএনপি সহ বিরোধী মতকে ঘরবাড়ী ছাড়া করে রেখে ছিলো। তবে এখানে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শের রাজনীতিটা এখনো মানুষের মনে গেঁথে আছে। এখনো জিয়া পরিবারে প্রতি সাধারন মানুষের ভালোবাসা সীমাহীন। কথা একটাই, ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে ধানের শীর্ষ। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মাহি বি চৌধুরী ফ্যাসিস্ট খুনী হাসিনার নির্দেশে এখানে জনগনের ভোটাধিকার হরন করে রাতের বেলা লাখ লাখ ভোট চুরি করে নৌকা প্রতীকে এমপি হয়। এই মাহি বি চৌধুরী আবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর কু-পুত্র। সে নিজের আদর্শকে জলাঞ্জলী দিয়ে স্বৈরাচারের নৌকায় উঠে ঘৃনার মহাসাগরে তলিয়ে গেছেন। ২০০৮ সালে ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সাজানো নির্বাচনে এই আসনে সুকুমার ঘোষ এমপি হয়ে পরবর্তী ২০১৪ সালেও ভোটাধিকার হরন করে বিনাবাঁধায় আবারো এমপি হয়ে একটানা ১০বছর রাজত্ব করেন। ২০২৪ সালের ৭জানুয়ারী খুণী হাসিনার ভারতীয় প্রেসক্রিপশনের ‘ডামী-স্বামী-আমরা’ পাতানো নির্বাচনে দেড়ফুটে এমপি হয় সিরাজদিখানের বাসিন্দা কুখ্যাত ভুমিদস্যু ও লুটেরা মহিউদ্দিন আহমেদ। এখানে এভাবেই একটি কলংকিত অধ্যায়ের রচনা করে বাকশালী আওয়ামীলীগের কাঠাল রানী হাসিনা।
অপরদিকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে প্রতিযোগিতা পূর্ন ভোটের মাধ্যমেই এই আসনটি বিএনপির দুর্গে পরিনত হয়। জিয়াউর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার এরশাদও জনগনের ভোটাধিকার হরন করে এই আসনটি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মাধ্যমে ৯ বছর দখলে রাখে। ৯১ সালে স্বৈরাচার এরশাদকে হটানো পরে বেগম খালেদা জিয়া জনতার সরাসরি ভোটে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর মাধ্যমে একটানা ১৫ বছর জিয়াউর রহমান আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আর একারনেই এখানকার মানুষ ধানের শীষকে এতো বেশী ভালোবাসেন। তবে বিগত ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট খুনী হাসিনার ক্যাডার সুকুমার ঘোষ, মহিউদ্দিন আহম্মেদ, গোলাম সারোয়ার কবীর, তোফাজ্জল হোসেন, মশিউর রহমান মামুন গংরা মাদক সিন্ডিকেট বিস্তার, জমিজমা-ঘরবাড়ী ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দখল, চাঁদাবাজি সহ মামলা-হামলা দিয়ে বিএনপির তৃণমুল নেতাকর্মীদের একশ একশ দৌড়ের উপরে রাখলেও বিএনপির ভোটব্যাংক খালি করতে পারেনি। এই অঞ্চলের বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ তলে তলে জয়বাংলা সেরাপ পান করেছেন, কেউ কেউ জেল খেটেছেন আবার কেউ কেউ বিএনপির দলীয় আদেশ অমান্য করে মেম্বার চেয়ারম্যান হয়েছেন। বিএনপির ভেতর গ্রুপিংকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ফ্যাস্স্টি বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে তাদেকে রাজপথে দেখাই যেত না। এরা তৃণমুল নেতাকর্মীদের কোন খোজ খবরই রাখতো না। আবার দুয়েকটি গ্রুপ যখন সাহস দেখিয়ে ফ্যাস্স্টি বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে নামতেন তখন অন্য গ্রুপের নেতারা তাদেরকে খুণী হাসিনার পুলিশলীগের কাছে রাতের আধারে ধরিয়ে দিতেন। তৃণমুল নেতাকর্মীরা এসবের প্রতিশোধে মুখ ফিরিয়ে নিলে এখন যারা এমপি হওয়ার দৌড়ে আছেন তারা ওয়ার্ড মেম্বার হতে পারবেনা। কারন খাটি বিএনপির ভোটার আর তৃণমুল কর্মীদের সাথে তাদের সম্পর্ক সাপ-বেজির মতো। ধানের শীষের টিকেট না পেলেই ঝাড়ু মিছিল নিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নেমে পড়েন।
২০২৪ সালের ৫আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট খুণী হাসিনা দেশ ছেড়ে পলায়নের পরে এই সংকট আরো তীব্র আকার ধারন করেছে। এখানকার বিএনপিকে ৫৪ গ্রুপে বিভক্ত করে গুটিকয়েক নেতা ৭৭হাত গর্ত বেরিয়ে এসে এখন পৌরষত্ব দেখাতে শুরু করেছে। ধানের শীষ না পেলেই গিরিবাজ কইতরের মতো ডিগবাজি দেয়া শুরু করবেন। একজনের কাছে তো ঝাড়ুর গোডাউন রয়েছে। এরা পৌরষত্ব আর খাই খাই, অমুক ভাই, তমুক ভাই বলে জারি-সারি গান গেয়ে সাধারন জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এদের গাড়ী বহর ও হোন্ডা বাহিনী নিয়ে জন-যাতায়তের রাস্তা বন্ধ করে মিছিল মিটিং করার কারনে সাধারন জনগণ খুবই বিরক্ত। ২০০৮ সালে নির্বাচনে এখানে ধানের শীষের টিকেট পেতে গাড়ী বহর নিয়ে রাস্তায় বের হতো অন্তত ডজন খানেক নেতা। যাদের বেশীভাগ নেতাকেই বিগত ১৫ বছরে এখানে কেউ চোখে দেখেনি, আর তাদের গল্পও শোনেনি। তবে হঠাৎ কোন মৃত্যু বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দুয়েকজনকে দেখা গেছে। শ্রীনগরের বিএনপিতে তাদের অবদান শূন্যের কোটায়। তাপরেও জিয়া পরিবারের আদর্শকেই ভালোবাসে এখানকার ভোটাররা। দলীয় সিন্ধান্তকে আপন করে নেয়।
শ্রীনগর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন এবং সিরাজদিখান উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে মুন্সীগঞ্জ-১ গঠিত। ২০২৪ সালে নির্বাচনে এই আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ছিলো ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১৫ জন। গুম, খুন ও গনহত্যা চালিয়ে আওয়ামীলীগ পালিয়ে গেছে। আগমী নির্বাচনে মাঠ থাকবে পুরোটাই ফাঁকা। তাই ধানের শীষের প্রতীক পেতে দুই নেতা প্রকাশ্যে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। আর একজন রয়েছেন কিছুটা নিরবে, আড়ালে আবডালে। বাকীদের কোন খরব নাই।
আগামী নির্বানকে সামনে রেখে ৫৪ গ্রুপে বিভক্ত নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ নিয়ে শ্রীনগর-সিরাজদিখানের এই প্রান্ত থেকে সেই প্রান্ত পর্যন্ত জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শ্রীনগরের বাসিন্দা মীর সরাফত আলী সপু। যদিও সাধারন ভোটারের সাথে তার সম্পর্ক তলানীতে। শোনা যাচ্ছে, তিনি দলীয় হাইকমান্ডের গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ন-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীর সাথে তার গভীর সম্পর্ক। কেন্দ্রীয় রাজনীতির মাঠে ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে রিজভীর পাশে তার উপস্থিতিও দেশবাসী লক্ষ্য করেছে। অন্তত সাড়ে ৩শ গায়েবী মামলায় অসংখ্যবার জেলখাটা আসামী মীর সরাফত আলী সপু নিজ নির্বাচনী এলাকায় একেবারেই ছিলেন নিষ্ক্রিয় ও সাধারন জনগনের সাথে সম্পর্কহীন। তবে ধানের শীষের টিকেট তার উঠলে নেতাকর্মী ও সাধারন জনগণ তাকে সাদরে গ্রহন করবে। আবার টিকেট না পাওয়ার বেদনায় আব্দুল্লাহ’র ঝাড়ু মিছিল এবং মমিন আলীর গ্রুপিং দেখা গেলে হতাশ হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিশিষ্ট শিল্পপতি, সমাজসেবক, আল মুসলিম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আলহাজ্ব শেখ মো: আব্দুল্লাহ সিরাজদিখান উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি। তিনিও বিএনপির বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত নেতাকর্মীদের একটি অংশ নিয়ে মাঠে ঘাটে জনমত গঠন করছেন। ২০১৮ সালে নির্বাচনে তিনি ধানের শীষের প্রার্থী তালিকায় ছিলেন। তবে শেষ মুহুর্তে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, এরশাদ সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী বর্ষিয়ান জননেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এর হাতে এই আসনে ধানের শীষ তুলে দেয়ায় অন্তর জ্বালায় দগ্ধ শেখ মো: আব্দুল্লাহ দলীয় হাইকমান্ডের সেই সিদ্ধান্তকে ঝাড়ু মিছিল দেখিয়ে রাস্তায় নেমে ছিলেন। জয়বাংলার শ্লোগান দিতে নিজের ছোট ভাই আমজাদ হোসেনকে বানিয়ে ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি। স্বার্থ পুরনে ডিগবাজি দিতে তার তেমন একটা সময় লাগে না। ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনের একজন সংগঠক আলহাজ মো: মমিন আলীকে তার নেতাকর্মী সহ ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টে মিটিংরত অবস্থায় পুলিশলীগ কাছে ধরিয়ে দেয়ার মতো গুরুত্ব অভিযোগও রয়েছে আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে। ধানের শীষের টিকেট পেতে অনেকটাই মরিয়া এই নেতা। শ্রীনগর-সিরাজদিখানের বিভিন্ন জায়গায় তাকে ও তার অনুসারীদেরকে অনেকটা প্রকাশ্যেই মিছিল মিটিং সভা সমাবেশ করতে দেখা যাচ্ছে।
তবে নিরব আলোচনায় রয়েছে আলহাজ মো: মমিন আলী। তিনি দীর্ঘ সময় শ্রীনগরের কোলাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, শ্রীনগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও শ্রীনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর শিষ্যখ্যাত এই নেতা বিএনপির দলীয় আদর্শের বাইরে যাননি। অনেকটা কষ্ঠ স্বীকার করে বিএনপি ধরেই পড়ে আছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের বুক দিয়ে আগলে রেখে ছিলেন। তবে গ্রুপিংয়ের শিকার হয়ে অনেকটা পেছনের সারিতে চলে গেছেন। তৃণমুল নেতাকর্মী ও সাধারন ভোটাররা তাকেই বেশী পছন্দ করেন। তার স্বচ্ছ ইমেজ এখানকার রাজনীতিতে যেকোন হিসাব পাল্টে দিতে পারে। অনেকটা নিরব প্রচারনায় কাটছে এই নেতা রাজনৈতিক সময়। দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার মতো সক্ষমতা তার রয়েছে।
এই তিন নেতাকে নিয়েই ধানের শীষের মাঠ সরগরম হচ্ছে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের নানা প্রান্তে। জনসাধারনের প্রত্যাশ বিএনপির দলীয় হাইকমান্ড কি এখানে সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন। না কি কোন একজনকে মাথার উপরে চাপিয়ে দিবে।