গণপূর্তের প্রকৌশলী আতিকুলের লুটপাটের ফিরিস্তি
স্টাফ রিপোর্টারঃ
ঢাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরে নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম ঘুরেফিরে ১৭ বছর ঢাকাতেই দায়িত্ব পালনের অন্তরালে গড়ে তুলেছেন অপকর্মের বিশাল সাম্রাজ্য। খুনী হাসিনার সান্নিধ্যে থেকে বনে গেছেন শতকোটি টাকার মালিক। প্রধান প্রকৌশলী মো: শামীম আখতারের সাথে সিন্ডিকেট গড়ে নিযোগ,বদলী,পদায়ন সহ গণপূর্তে বিভিন্ন জোনাল অফিসে বাজেট বরাদ্দ করতেন বলে মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের ৮/৯ মাসে নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেকেই বলেন, তার কাছে মোটা অংকের টাকা দিলে পছন্দের টেবিলে পোষ্টিং বা পদায়ন পাওয়া যায়। তিনি ৫আগষ্টের আগে ছাত্র জনতার আন্দোলন দমন করতে খুনী হাসিনার গুন্ডা বাহিনীকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছিলেন। ডিএমপির যুগ্ন কমিশনার বিপ্লব বড়ুয়াকে নিজের বন্ধু পরিচয়ে দিয়ে গণপূর্তের ভেতর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এখন আবার ভোল পাল্টে বিএনপি জামাত ও এনসিপির লোক বলে জাহির করেন।
সূত্র বলছে, অধিদপ্তর গণপূর্ত অধিদফতরে গত ১৭ বছর ধরে গড়ে উঠা লুটপাটের সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের মধ্যে একজন প্রভাশালী নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম। তিনি ঘুরেফিরে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশন অফিস গুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি ঢাকা সেগুনবাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশনে নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, আতিকুল ইসলাম, গণপূর্ত অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ নির্বাহী প্রকৌশলীদের গডফাদার। ঘুরেফিরে ঢাকার এক ডিভিশন থেকে আরেক ডিভিশনে বদলি হন তিনি। ৩ বছর পরপর বদলীর বিধি থাকলেও গত ১৭ বছরে ঢাকার বাইরে বদলী হয়নি তার।
জানা গেছে, তিনি চাকুরী জীবনের প্রায় ২০বছরের শিক্ষানবিশকাল বাদে পুরোটা সময় ঢাকায় কাটিয়েছেন । বিগত দিনে মন্ত্রী, সচিব, প্রধান প্রকৌশলী আর প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের কোটায় মূলত তিনি নিজের ইচ্ছামাফিক বদলি বাগিয়ে নিয়েছেন, যা এখনো অব্যাহত আছে। সর্বশেষ গত ১৪ জুলাই তাকে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-১ থেকে শেরেবাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ-৩ এ তাকে বদলি করা হয়। এ দুটি বিভাগই গণপূর্তের বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং লোভনীয় পোস্টিং হিসেবে বলা হয়।
আতিকুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলীর কর্মজীবনে সহকারী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন ডিভিশনে দীর্ঘ সময়ে কর্মরত ছিলেন। দুর্নীতি ও অর্থ পাচার এবং জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ আছে, অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের আস্থাভাজন হিসেবে টেন্ডার, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের সকল কাজই নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম সমন্বয় করে থাকেন। টাকা খরচের জায়গা না থাকার পরও প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার অনেকটা রহস্যজনক ভাবে এই প্রকৌশলীকে ২১কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দেওয়ায় বেশ সমালোচনা দেখা দিয়েছিল অধিদপ্তরে।
জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ২০০৫ সালে বিএসসি সিভিল শেষ করেন। বিসিএস পাবলিক সার্ভিস ক্যাডার ২৭ ব্যাচে উত্তীর্ণ হয়ে চাকুরীতে যোগদান করেন। ২০০৮ সালে সহকারী প্রকৌশলী ২০১০ সাল থেকে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন আতিকুল ইসলাম। শিক্ষানবিশকালের ঐ সময়টুকু তিনি ঢাকার বাইরে চাকরি করেন।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পদোন্নতি পেয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকা-১ এ যোগদানের পর ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত একই পদে ছিলেন। তারও আগে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে দুই দফায় দুই উপবিভাগে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। মাঝে ঢাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের রক্ষনাবেক্ষন বিভাগের কর্মরত ছিলেন। প্রভাবশালী ও আস্থাভাজন নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলামকে টেন্ডার সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা হিসেবে দাবি করেন ঠিকাদাররা।
সূত্র জানায়, ঘুপচি টেন্ডার থেকে ‘বিশেষ ক্লোলাজ’ তার বিশেষত্ব, তাই বাইরে থেকে খালি চোখে এসব সূক্ষ্ম দুর্নীতি তেমন চোখে পড়েনা। দুর্নীতিবাজ আতিকুল ইসলামকে দেওয়া হয়েছে ডাটাবেজ তৈরির কাজ। সংস্থাটির সকল ডিজিটাল এক্সেস কাজে লাগিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন অপ্রতিরোধ্য।
দুদকের অভিযোগে বলা হয়, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তার সকল রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পুনরায় অডিট করলে অন্তত: ৫০কোটি টাকার গরমিল পাওয়া যাবে। যেহেতু তিনি প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের সিন্ডিকেট সদস্য, তাই তার অপকর্ম সামনে আসেনি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার আমলে টেন্ডার বাণিজ্যে করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম।
অভিযোগ আছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের রক্ষনাবেক্ষন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে বিভিন্ন ঠিকাদারের নিকট হতে অধিক পরিমাণ উৎকোচ গ্রহণ করে অনুমোদিত বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা হতে ৩ বছরে তিনি প্রায় ৬০ কোটি টাকার অতিরিক্ত দরপত্র আহবান করে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-১ এ বদলী হয়ে চলে যান। এই অতিরিক্ত ৬০ কোটি টাকার দরপত্র আহবান করে সুকৌশলে ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
একই সময় রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় কয়েকটি পরিত্যক্ত বাড়ি ও তিনটি ভবন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী (রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ) নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম। খরচ করার জায়গা না থাকলেও ওই অর্থবছরে ১২০টি কাজের বিপরীতে রহস্যজনকভাবে ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন এই প্রকৌশলী। তা তখন নানা সমালোচনার জন্ম দেয়।
জানা যায়, সে সময় নিন্মমানের কাজ ও কাজ থেকে অর্থ আত্মসাৎ অভিযোগ তখনকার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়। মন্ত্রীকে টাকা দিয়ে সেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের জন্য একটি কমিটি করা হয়, এমন নজির আগে দেখাও যায়নি। শুধু মাত্র কমিশন বাণিজ্যই ছিল সেই কমিটির মূল কাজ। কমিটির অনুমোদন নেওয়ার নামে মতিঝিল গণপূর্ত বিভাগ থেকে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-১ এ হস্তান্তরে দুই বিভাগের মধ্যে ৫ কোটি টাকার অনুমোদন ফি নেওয়া হয়।
এভাবে অবৈধ অর্থ উপার্জন করে তিনি ময়ময়সিংহে ২৫বিঘা জমির ওপর মাছের খামার গড়ে তুলেছেন। যেটি তার শ্যালক পরিচালনা করছে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় তার ১৪/১৫টি প্লট ও ফ্ল্যাট রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। দুদকের চোখকে ফাঁকি দিতে এসব সম্পত্তি তিনি বেনামে ক্রয় করেছেন। দুদক অনুসন্ধান করলেই তার থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।