কেরানীগঞ্জে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার, কৌশলে সক্রিয় কারবারিরা

কেরানীগঞ্জে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার, কৌশলে সক্রিয় কারবারিরা
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি: ঢাকার প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় কেরানীগঞ্জের বসিলা, বাবুবাজার ও পোস্তগোলা সেতুকে মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চক্রগুলো। এসব সেতুর মাধ্যমে ইয়াবা, ফেন্সিডিল, মদ, বিয়ার ও গাজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য ঢুকছে কেরানীগঞ্জে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান চালালেও মাদক কারবারিরা নানা কৌশলে সক্রিয় রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের নতুন বাক্তারচর, হাসনাবাদ হাউজিং, বালুরমাঠ, ঝিলমিল প্রজেক্ট, শুভাঢ্যা কৈবর্তপাড়া, পারগেন্ডারিয়া, সাবান ফ্যাক্টরি কলেজসহ বিভিন্ন এলাকায় অবাধে চলছে মাদক ব্যবসা ও সেবন। এছাড়া মডেল থানাধীন শহীদনগর মাঠ, মনুবেপারীর ঢাল, বাঁশপট্টি নদীর পাড়, মাদারীপুর-বরিশুর, কদমতলী মডেল টাউন ও জিনজিরাসহ একাধিক স্থানেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
এদিকে গত বুধবার (৬ আগস্ট) সন্ধ্যায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের নতুন বাক্তারচর সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শনের সময় একটি ঘর সন্দেহজনক মনে হওয়ায় উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে চারজন মাদকসেবী ও ঘরের মালিককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন কালিন্দী ইউনিয়নের মাদারীপুর এলাকায় দিন দিন বেড়েই চলেছে মাদকের অবাধ ব্যবসা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদারীপুর জামে মসজিদের পশ্চিম পাশের রাস্তা ও আশপাশের এলাকায় সংঘবদ্ধ একটি চক্র প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করছে। এতে এলাকাবাসীর মধ্যে তৈরি হয়েছে চরম উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতা। দ্রুত এই সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন তারা।
স্থানীয়রা আরও জানান, বরিশুর ২৩ ও ২৪ এবং ব্রাহ্মণকিত্তা ১ ও ২ নম্বর পিলার এলাকার আশপাশে প্রতিদিনই চলছে মাদক কেনা-বেচা। এ কাজে স্থানীয়ভাবে পরিচিত একাধিক ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে জড়িত বলে জানিয়েছেন তারা।
স্থানীয় বিএনপি নেতা সেলিম রেজা বলেন, “মাদক এখন এ এলাকায় মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন যুবক এই মাদকের ফাঁদে পড়ে ধ্বংস হচ্ছে। আমরা বারবার প্রশাসনকে জানিয়েছি, কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদি এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”
নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্থানীয় এক শিক্ষক  বলেন, “মাদারীপুর এলাকায় মাদক ব্যবসা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করলেও, কয়েক মাসের মধ্যেই তারা জামিনে বের হয়ে পুনরায় একই ব্যবসায় লিপ্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এভাবে বারবার গ্রেফতার হলেও শাস্তির নিশ্চয়তা না থাকায় মাদক ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মাদকের ভয়াল ছোবল থেকে যুবসমাজকে বাঁচাতে হলে এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধু অভিযান নয়, প্রয়োজন স্থায়ী ও কার্যকর ব্যবস্থা।”
বুধবার (২০ আগস্ট) বিকেলে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আগানগর বেড়িবাঁধ এলাকায় কেরানীগঞ্জ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সমিতির আয়োজিত আলোচনা ও মতবিনিময় সভায় বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সারা কেরানীগঞ্জ মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “মাদকের এই পয়সা ক্ষমতাধরদের পকেটে আসে। পুলিশ ফাঁড়ির পাশে মাদকের রমরমা ব্যবসা চলছে। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের উদ্দেশে বলছি, নীরবে সময় কাটাবেন না।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে মাদক নিয়ে গভীর কোনো গবেষণা নেই। দেশে কতসংখ্যক মাদক কারবারি ও মাদকসেবী রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ জানান, ‘২০১৮ সালে ৩৬ লাখ মাদকসেবীর তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। গত ছয় বছরে আর হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ মো. আক্তার হোসেন জানান, ঝিলমিলের পুরো এলাকাটাই ফাঁকা। ভিতরে ঘন জঙ্গল ও বনভূমি। ওখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা, অনেক সময় অপরাধীরা ওখানে অবস্থান করে। কিন্তু সেখানে কোনো লাইটিং এর ব্যবস্থা নেই। যার ফলে সন্ধ্যা গড়িয়ে  রাত হলে অপরাধীরা নির্বিচারে সেখানে অবস্থান নিতে পারে। তবে “মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছে।কোন অবস্থাতেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল হক ডাবলু বলেন, “মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর রয়েছে। মাদারীপুর এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা পুলিশ ইতোমধ্যে অভিযান চালাচ্ছে। পাশাপাশি সাদা পোশাকের একাধিক টিমও নিয়মিত কাজ করছে। কোন অবস্থাতেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
কেরানীগঞ্জবাসীর দাবি, অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তাই মাদকের ভয়াল ছোবল থেকে যুবসমাজকে বাঁচাতে হলে এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।